ডেস্ক নিউজ
সরকার নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে একাধিক সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ায় গত কয়েকদিনে ডিম, ব্রয়লার মুরগি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও কাঁচা মরিচের পাশাপাশি বেশকিছু খাদ্যদ্রব্যের দাম বড় ধাপে কমেছে। আরও বেশকিছু নিত্যপণ্যের দাম কমার তালিকায় যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ইতোমধ্যে ডলারের আকাশ ছোঁয়া মূল্য বেশখানিকটা নেমে স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছেছে। বেড়েছে রেমিট্যান্সের গতি প্রবাহ। আমদানিতে কিছুটা লাগাম টেনে রপ্তানি বাড়ানোয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান কমতে শুরু করেছে। এতে অস্থিতিশীলতার কালো মেঘ কেটে যাওয়ায় সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছে; দেশ ফের স্বস্তিতে ফিরছে। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের দাবি, বৈশ্বিক সংকটে ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের বাজারে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, আগামী এক মাসের মধ্যেই তা অনেকাংশে কেটে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে শিগগিরই সুবাতাস বইবে। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি নানা চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে তাদের সে ষড়যন্ত্র পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব হবে। এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কশাঘাতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের যখন নাভিশ্বাস, ঠিক সেই দুঃসময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সারা দেশে চরম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এতে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থারও ঘাটতি দেখা দেয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রকারী চক্র ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালায়। যা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। তবে সরকারের দক্ষ হস্তক্ষেপে যার অনেকটাই ইতোমধ্যেই সামাল দেওয়া গেছে। এতে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা যেমন বেড়েছে, তেমনি দেশের মানুষের মধ্যে স্বস্তিও ফিরছে। শিল্প মালিকরা জানান, গ্যাস ও বিদু্য সংকটে গত কয়েক মাসে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার উৎপাদন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। তাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। চলতি মাসের প্রথম ভাগেও এ অবস্থা চলমান ছিল। তবে সম্প্রতি শিল্প খাতে গ্যাস-বিদু্যৎ সরবরাহ বৃদ্ধি ও রেশনিংসহ নানা কৌশলী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সরকার এ সংকট কাটানোর ছক তৈরি করেছে। শিল্প খাতে ইতোমধ্যেই এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শিল্প মালিকরা আশাবাদী, গ্যাস-বিদু্যৎ সরবরাহ আরও খানিকটা স্বাভাবিক হলে সংকটকালীন সময়ের ঘাটতিও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর বস্ত্র ও গার্মেন্ট শিল্প নতুন করে চাঙা হয়ে উঠলে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা অনেকাংশেই কেটে যাবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ডক্টর তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্বজুড়েই জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বিদু্যৎ রেশনিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বৈশ্বিক সংকটকালে দেশের অর্থনীতি চাঙা রাখতে চলমান গ্যাস-বিদু্যৎ রেশনিংয়ে শিল্প ও কৃষি খাত অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিল্প মালিকরা জানান, সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে শুধু তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন, তা নয়। বরং এতে দেশের অর্থনীতির গতি ফিরছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রতিটি মানুষ এর সুফল পাবেন। এদিকে শুধু শিল্প মালিকরাই নন, আমদানি-রপ্তানিকারক ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ক’দিন আগেও যে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে। আমদানি-রপ্তানিকারকরা বলছেন, ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের নানা কৌশলী পরিকল্পনার সুফল ইতোমধ্যেই মিলতে শুরু করেছে। অবস্থার আরও খানিকটা উন্নতি হলে বিলাসী পণ্যসহ যেসব পণ্য আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে, তা শিথিল করা সম্ভব হবে। ডলারের চড়া মূল্যের কারণে পণ্য রপ্তানির পরিমাণে যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটবে। এদিকে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, সরকারের বিশেষ তৎপরতায় একে একে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে থাকায় পণ্যমূল্য যেমন কমছে, তেমনি ব্যবসাও চাঙা হচ্ছে। এতে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা হতাশ হলেও সরকারের ওপর সাধারণ ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়ছে। এ ব্যাপারে তারা উদাহরণ টেনে বলেন, দুই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ডিমের দাম ডজনে ৪০ টাকা বাড়লেও এতে খামারি কিংবা সাধারণ ব্যবসায়ীরা কেউ লাভবান হননি। বরং আকাশচুম্বী দরের কারণে বিক্রি কমায় তারা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া ব্রয়লার মুরগি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও কাঁচা মরিচের দাম ধাপে ধাপে কমতে শুরু করায় ভোক্তাদের মতো বিক্রেতারাও খুশি। তাদের ভাষ্য, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এখন আর নিম্নবিত্তরা চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যপণ্য কিনছেন না। বরং বাড়তি দাম ও সামর্থ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্য কেনা কমিয়ে দিচ্ছে। তাই ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্যে বিক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এদিকে গত কয়েক দিনে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা অনেকখানিই কেটেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি পণ্য আমদানিতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এতে আমদানির পরিমাণ কমে এসেছে। অন্যদিকে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। কমছে ডলারের দাম, বিপরীতে বাড়ছে টাকার মান। অন্যদিকে দেশে ডলারের সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা কৌশলী ছক গ্রহণ করে। এর মধ্যে আমদানিতে দেওয়া নানা শর্ত এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নীতিগত ছাড় দেওয়া; ডলার কারসাজির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে অভিযান পরিচালনা এবং অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ বেশ কাজে লেগেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখাপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় রেট থেকে এক টাকা বেশি দামে ডলার কিনে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফা করতে বলা হয়। এর আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ মুনাফার সীমা এক টাকা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। ডলারের সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। বাজার ক্রমেই স্থিতিশীল হয়ে আসছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১৬ দিনে ১১৭ কো?টি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় (প্র?তি ডলার ৯৫ টাকা ধ?রে) এর পরিমাণ ১১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। কমেছে আমদানি এলসি খোলার হারও। আমদানির লাগাম টানতে যেসব শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তার সুবিধা আসতে শুরু করেছে। অন্যদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১১ দিনে পণ্য আমদানির জন্য ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। আগের মাস জুলাইয়ের এই ১১ দিনে ২ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। তার আগের মাস জুনের ১১ দিনে খোলা হয়েছিল ২ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের এলসি। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫৫৫ কোটি (৫.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা জুনে ছিল ৭৯৬ কোটি (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ জুন থেকে জুলাই মাসে এলসি খোলা কমেছে ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ। জুনে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭৭৫ কোটি ডলার। জুলাইয়ে সেটি ১১৭ কোটি ডলার কমে ৬৫৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো উলস্নম্ফন দেখা যাচ্ছে। আগস্টের প্রথম ১০ দিনেই ৮১ কোটি ৩০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের আগস্টের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো মাসেই ১০ দিনে এত বেশি রেমিট্যান্স কখনই দেশে আসেনি। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে ১০ দিনের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ৮ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ৭৭২ কোটি টাকা। বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১১০ টাকার বেশি দরেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ আরও বেশি। মাসের বাকি সময়ও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে, এমন আশার কথা শুনিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, জুলাই মাসের মতো আগস্ট মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে। জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে এটি বেশি ১২ শতাংশ। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে ওই অর্থের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলেন, করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে কয়েক দিন আগে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে যখন দেশজুড়ে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছিল, তখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘মহামারির মধ্যে ওই সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন প্রবাসীরা। আর এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতিতে যে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে, সেই সংকট কাটাতেও সেই প্রবাসীরাই সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ উলেস্নখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। সেখানে কর্মরত আমাদের প্রবাসীরা বেশি আয় করছেন। দেশেও বেশি টাকা পাঠাতে পারছেন। দেশে ডলারের সংকট চলছে। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে। রিজার্ভ কমছে। এই মুহূর্তে রেমিট্যান্স বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো হবে- যোগ করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের ফলে আমদানি কমতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে এটা সত্যিই স্বস্তির খবর। এভাবে আমদানি কমলে আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়লে খুব শিগগিরই সব সংকট কেটে যাবে।