ডেস্ক নিউজ
শুকনো মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধূলিওড়া মেঠোপথ ও রূপালি নদী। আর বর্ষায়? এই রূপালি নদীগুলোই ফুঁসে ওঠে। দুই তীর ছাপিয়ে ভাসায় ফসলি মাঠ। সাগর হয়ে ওঠে চারপাশ। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর একেকটাকে তখন ছোট দ্বীপের মতো লাগে। দূর থেকে মনে হয় কচুরিপানা হয়ে পানিতে ভাসছে গ্রামগুলো। কী শুকনো কী বর্ষা- সব ঋতুতেই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে কিশোরগঞ্জের হাওর।
হাওরের এই সৌন্দর্যে এখন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে নান্দনিক এক সড়ক। হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে চলে গেছে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি। সড়কের দু’পাশে থৈ থৈ পানি, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। মেঘ আর জলের এই মনোরম মিতালির সামনে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে মানুষ। সড়কের পাশে বসে বুক ভরে ওঠে নির্মল বাতাসে। নান্দনিক এই পথটিই অলওয়েদার সড়ক- নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় যেটি আগামীকাল বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাল সকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাওরবাসীর স্বপ্নের এ সড়ক উদ্বোধন করবেন তিনি। কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী সমকালকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গভীর হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য তৈরি করা নান্দনিক এই সড়ক এখন সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে হয়ে উঠেছে দুর্নিবার আকর্ষণ। এর ফলে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় উন্মোচিত হয়েছে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন আকাশ।
এ সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘ভাটির শার্দুল’ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। হাওরবাসীর কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অভিপ্রায় অনুযায়ী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে জেলার তিন উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের লক্ষ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।
কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশেদুল আলম জানান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অলওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭.৬০ লাখ বর্গমিটার সিসি ব্লক দিয়ে স্লোপ প্রটেকশনের কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬১.৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১.৯৬৪ মিটার ঢাকী সেতু এবং ১৫৬.৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু- এ তিনটি সেতু সড়কটির সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জের পূর্ব প্রান্তে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা নিয়ে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার অবস্থান। হাওর অধ্যুষিত এই তিনটি উপজেলা যোগাযোগহীন হওয়ায় এবং বছরের অর্ধেকের বেশি সময় জলমগ্ন থাকায় অনগ্রসর ও দুর্গম হিসেবে পরিচিত। অলওয়েদার সড়ক শুরু হয়েছে ইটনা উপজেলা সদর থেকে। এরপর ধনু ও বাউলাই নদীর সমান্তরালে সম্পূর্ণভাবে বিস্তীর্ণ হাওরের মধ্য দিয়ে মিঠাইন উপজেলা সদর হয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরে গিয়ে শেষ হয়েছে। বর্ষাকালে হাওরের পানির প্রচণ্ড স্রোতে যেন নির্মিত সড়ক-বাঁধের ক্ষতি না হয়, সেজন্য সড়কের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যে বাঁধের উভয় পাশের স্লোপে সিসি ব্লক দিয়ে প্রতিরক্ষা কাজ ও সড়ক বাঁধের স্থায়িত্বের জন্য টো-ওয়াল বরাবর সিসি ব্লক দ্বারা ফলিং অ্যাপ্রোনের কাজ করা হয়েছে। বর্ষায় সড়কের দু’পাশের গ্রামগুলো নৌপথে যাতায়াতের লক্ষ্যে সড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শুস্ক মৌসুমে কৃষি জমিতে যেন সেচ কাজে বাধা না পড়ে এবং হাওরের উৎপাদিত ফসলবাহী যানবাহন যেন সড়কের নিচ দিয়ে অনায়াসে যেতে পারে, সেজন্য সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই সড়কটি দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন সৌন্দর্য ও ভ্রমণপিপাসুরা।
মিঠামইনের ইউএনও প্রভাংশু সোম মহান বলেন, অলওয়েদার সড়ক হাওরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে। এ সড়ক হওয়ায় হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে এখানকার অনেক মানুষ দিনে ৫০০ টাকা আয় করতে পারত না। অথচ এখন একই ব্যক্তি দিনে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা আয় করছেন। তার মতে, মিঠামইনে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। একইভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অষ্টগ্রাম এবং ইটনায়ও। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এত দ্রুত বদলে যাবে, তা কেউ কল্পনাও করেনি।
কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, সড়কটি হওয়ার ফলে তিন উপজেলার মানুষের যোগাযোগসহ পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে হাওরের অলওয়েদার সড়কটি সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে যুক্ত হবে। এ ছাড়া হাওরে ফ্লাইওভার নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।