আমদানির ঘোষণাতেই কমতে শুরু করেছে চালের দাম। মিলগেট, পাইকারি এবং খুচরাÑ সব পর্যায়ে চালের দাম কমেছে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা আর বস্তাপ্রতি কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আমদানি করা চাল বাজারে আশা শুরু হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দাম আরও কমবে বলে জানায় চাল ব্যবসায়ীরা। সোমবার মিলমালিকদের সঙ্গে কথা বলে এবং পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে। আমদানি করা চাল দেশের বাজারে এখনও তেমন একটি না এলেও দাম কমে আসায় প্রশ্ন উঠেছেÑ মিলমালিকরাই তা হলে চালের দাম বৃদ্ধি ও কমানোয় মুখ্য ভূমিকা রাখছে। কারণ এতদিন তারা বলে আসছিল, দেশে ধানের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই, তাই দাম বেড়েছে। আর ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দামও বেড়ে যায়। কিন্তু চাল আমদানির খবরে হুট করে দাম কমে যাওয়ায় পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেÑ এখন মিলমালিকরা কীভাবে চালের দাম কমাল, হঠাৎ করেই বাজারে ধানের সরবরাহ বাড়ল কী করে। মিলমালিকরা এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
এদিকে তিন দফায় এখনও পর্যন্ত ১৮৫টি প্রতিষ্ঠানকে সরকার চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। বেশ কিছু শর্তে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮৭ হাজার টন চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সোমবার ৭২টি প্রতষ্ঠানকে ১ লাখ ৪১ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। আগের দিন রোববার ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১ লাখ ৭১ হাজার টন এবং গত ৬ জানুয়ারি ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৭৪ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ৪ লাখ ৮৭ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলো বেসরকারি খাতে।
বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির প্রথম চালান হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ইতোমধ্যেই দেশে চলে এসেছে। গত শনিবার প্রথম চালানের তিনটি চালবাহী ট্রাক হিলি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রথম দিনে ওই তিন ট্রাকে চাল এসেছে ১১২ টন। ফলে ৩৫ মাস পর এই বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করল ভারতীয় চালবাহী ট্রাক।
হিলি স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, মেসার্স জগদীশ চন্দ্র রায় নামে একটি প্রতিষ্ঠান হিলি স্থলবন্দর দিয়ে শনিবার ভারত থেকে প্রথম চালানের চালগুলো নিয়ে আসে। আমদানিকারক মেসার্স জগদীশ চন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি শ্রীপদ জানান, সরকারের বিভিন্ন শর্তাবলি মেনে ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম চালানের ৬০০ টনের মধ্যে ১১২ টন চাল দেশে প্রবেশ করেছে। মূলত চাল আমদানির এ খবরেই টানা কয়েক মাস পর দাম কমতে শুরু করেছে। সোমবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকন চালে কেজিপ্রতি কমেছে ২ থেকে ৩ টাকা আর মোটা চালের কেজিতে কমেছে ৩ থেকে ৪ টাকা। রাজধানীর অন্যতম প্রধান খুচরা বাজার কারওয়ান বাজারের মুক্তা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. শাহজাহান সময়ের আলোকে জানান, এক সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি ভালোমানের রশিদ, ডায়মন্ড ও মঞ্জু ব্র্যান্ডের মিনিকেটের কেজি ছিল ৬৩-৬৫, তা এখন কমে বিক্রি হচ্ছে ৬১-৬২ টাকায়। এসব চাল ৫০ কেজির বস্তায় ১০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকার বদলে ৩ হাজার ১০০ টাকায়। তা ছাড়া মাঝারি মানের রানা ও নজরুল ব্র্যান্ডের প্রতিকেজি ৬১ টাকার বদলে ৫৯-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবস্তা ৩ হাজার ৫০ টাকার বদলে এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯৫০ টাকায়। তিনি জানান, গত কয়েক মাসে চিকন চালের চেয়ে মোটা চালের দাম যেমন বেশি বেড়েছে, তেমনি এখন দামও কমেছে মোটা চালের বেশি। বিআর২৮ চালের কেজি এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৪ টাকা। এখন ৫০ টাকায় নেমেছে। বস্তাপ্রতি কমেছে ২০০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে ৫০ কেজির বস্তা ছিল ২ হাজার ৬০০, এখন হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
আরেক মোটা চাল স্বর্ণার দামও কমেছে কেজিতে ৪ টাকা। এক সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি স্বর্ণার দাম ছিল ৫০ টাকা। এখন কমে হয়েছে ৪৬ টাকা। বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকার বদলে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। তা ছাড়া পাইজামেও কমেছে কেজিতে ৩-৪ টাকা। ৪৮-৫০ টাকার বদলে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৬-৪৭ টাকায়। এই মানের চালেও বস্তাপ্রতি কমেছে ২০০ টাকা। ২ হাজার ৫০০ টাকার বদলে এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ টাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারের আনুপাতিক হারে চালের দাম কমেছে পাইকারি বাজার ও মিলগেটে। রাজধানীর বৃহৎ চালের বাজার মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট। এই বাজারে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চালের ব্যবসা করেন জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির মালিক হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, পাইকারি বাজারেও বস্তাপ্রতি প্রায় সব রকম চালের দাম গড়ে ১৫০-২০০ টাকা করে কমেছে। আর পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি দাম কমেছে ২-৩ টাকা।
চালের দাম হঠাৎ কমে আসার কারণ সম্পর্কে হাবিবুর রহমান সময়ের আলোকে জানান, কারণ একটিই সরকারের চাল আমদানির ঘোষণা। সরকারের ঘোষণাতেই চালের দাম বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা কমেছে। এতেই বোঝা যায়, চালের দাম কমা ও বৃদ্ধি পাওয়া পুরোটাই মিলমালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কারণ সরকার চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে, এখনও খুব বেশি আমদানি করা চাল দেশে আসেনি। তাতেই চালের দাম কমেছে। মিলমালিকরা এখন কীভাবে চালের দাম কমাল। এতদিন তারা বলে আসছিল, দেশে ধানের ঘাটতি রয়েছে, তাই দাম বেড়েছে। আর ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দাম বেড়েছিল। এখন তা হলে হঠাৎ করে ধানের সরবরাহ বাড়ল কী করে, চালের দামই বা কমল কীভাবে। আসলে মিলমালিকরা সিন্ডিকেট করে ধান মজুদ করে রেখেছিল লাখ লাখ টন। এখন তারা দেখছে আমদানি করা চাল দেশে চলে এলে ধান-চালের দাম কমে যাবে। তাই আগে থেকেই মিলমালিকরা চালের দাম কমিয়ে দিয়েছে।
অবশ্য কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে জানান, চালের বাজারে মিলমালিকরাই মূল সিন্ডিকেট করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার যদি মিলমালিকদের ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করত তা হলে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিত না। তা ছাড়া সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি করে ফেলেছে। অন্তত আরও দুই মাস আগে থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ নিতে হতো। গত নভেম্বরে সরকার যখন মিনিকেট চালের মূল্য বস্তাপ্রতি ২ হাজার ৫০০ এবং বিআর২৮ চালের বস্তাপ্রতি মূল্য ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল তখনই আমদানির উদ্যোগ নিতে হতো। তা হলে চালের বাজার এত অস্থির হতো না।
মিলমালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে কুষ্টিয়া চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদীন সময়ের আলোকে জানান, মিলমালিকরা কোনো সিন্ডিকেট করে না। আসলে মিলমালিকদের কাছে পর্যাপ্ত ধান নেই। প্রতিমণ ধানের দাম এখন ১ হাজার ৩০০ টাকা। এ দামে ধান কিনে চাল তৈরি করার পর প্রতিবস্তা মিনিকেটে দাম পড়ে ২৯৫০ টাকা। অথচ আমরা এখন বিক্রি করছি ২ হাজার ৯০০ টাকায়। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা লোকসান দিয়ে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে আমাদের। আমাদের ওপর অন্যায়ভাবে দোষ চাপানো হয় সবসময়।