ডেস্ক নিউজ
পদ্মা ও মেট্রোরেলে বরাদ্দ কমলেও এবারও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ যাচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। এ খাতে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে থাকছে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাত। এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হতে পারে ৩৯ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়ন অন্তর্ভুক্ত করলে এটা দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আগামীকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনেতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় নতুন এই এডিপি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এনইসি চেয়ারপার্সন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।
গত দুই বছরে করোনার কারণে উন্নয়ন বাজেটের আকার কিছুটা সঙ্কুচিত করে সরকার। ওই সময় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আকার ৪ থেকে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। মূলত কাক্সিক্ষত রাজস্ব আয় না বাড়ায় উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কিছুটা লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া করোনার কারণে এডিপির বাস্তবায়নও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এবার ভিন্ন চিত্র। অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ায় এডিপি আগের ধারায় ফিরেছে। ফলে এবার আগের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বরাদ্দ বাড়িয়ে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি প্রস্তাব করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এলাকার উন্নয়নে জনপ্রতিনিধিদের চাহিদার চাপ রয়েছে। এ ছাড়া অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ায় গতি বেড়েছে উন্নয়ন কাজের। এসব কারণে বেশি খরচের লক্ষ্য নিয়ে নতুন এডিপি সাজানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত এডিপি হচ্ছে সম্প্রসারণমূলক।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপির) আকার ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে মূল এডিপি থেকে ৮ শতাংশ কাটছাঁট করে সংশোধিত এডিপি নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। এখানে দেশীয় অর্থ অপরিবর্তিত রেখে বিদেশী সহায়তার অংশ কমিয়ে সংশোধিত এডিপি চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা গত মার্চে অনুমোদন পায়।
দেশের বহুল প্রত্যাশিত চার মেগা প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ দিকে। এ বছরই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আগামী অর্থবছর উন্মুক্ত হবে মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং কর্ণফুলী টানেল। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যেই এসব প্রকল্প জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়ায় বরাদ্দও কম লাগছে। কারণ, এসব প্রকল্পে বড় ধরনের কোন নির্মাণকাজ নেই। ফলে সরকারের ওপরও বাড়তি বরাদ্দের চাপ কমছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি এবং মেট্রোরেল প্রকল্পে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২ হাজার ২০২ কোটি এবং মেট্রোরেল প্রকল্পে ২ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ কমার ফলে সরকারও কিছুটা চাপ মুক্ত হচ্ছে। ফলে ওই অর্থ এখন অন্য উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ করা যাবে।
তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দের চাপ কমলেও চাপ বাড়ছে কর্ণফুলী টানেলে। কারণ এই প্রকল্প আগামী অর্থবছরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মেগা প্রকল্পের মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে ১২০ কোটি, পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পে ৫ হাজার ৮০০ কোটি, বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু (বা যমুনা রেল সেতু) প্রকল্পে ৩ হাজার ৮৫০ কোটি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পে ১৩ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু টানেলে ২ হাজার কোটি, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পে ৬ হাজার ৮১৫ কোটি এবং পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে ৫১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। অথচ শুরুতে এসব প্রকল্পে অনেক বেশি বরাদ্দের চাপ ছিল।
তবে প্রস্তাবিত এডিপিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত ৬৯ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। যা মোট এডিপির ২৮.৭৩ শতাংশ। মূলত দেশের পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নে চলমান বেশ কিছু মেগা প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাতের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান।
সড়ক, রেল ও বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের মধ্যে কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল (এমআরটি-৬), যমুনা রেল সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এ কারণে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে চলতি অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫৫,৮২৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় প্রস্তাবিত এডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বরাদ্দ বেড়েছে ১৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।
এর পরই রয়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুত বিভাগ। এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৩৯ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকছে ২৯ হাজার ৮১ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এডিপিতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়িয়ে মূলত এডিপির ১১.৮২ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপিতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ৩৬.৪৮ শতাংশ। অবশ্য চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে শিক্ষা খাতে ১০.২৯ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হলেও সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ৩.৮১ শতাংশ করা হয়।
আগামী বছর স্বাস্থ্য খাতে ১৯ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে এডিপির বরাদ্দ ছিল ৭.৬৮ শতাংশ, আর প্রস্তাবিত এডিপিতে এ খাতের বরাদ্দ সামান্য বাড়িয়ে ৭.৮৩ শতাংশ করা হয়েছে। শতাংশের হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়লেও টাকার অংশে ১০,৮২০ কোটি টাকা বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বেড়েছে ৫,৪৮০ কোটি টাকা।
এছাড়া স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগে ১৬ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে এক হাজার ২৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এটা সাধারণ হিসাব। প্রকল্পের কাজ শুরুতে বা মাঝখানে বেশি বরাদ্দ দিতে হয়। তবে ধীরে ধীরে প্রকল্পের কাজ যখন সমাপ্ত হতে থাকে তখন বরাদ্দের চাপও কমতে থাকে। আমরা এই অর্থবছরে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল খুলে দিতে পারব। এসব প্রকল্পের কাজ প্রায় শতভাগ সমাপ্ত। টাকা খরচের কোন জায়গা নেই, স্বাভাবিকভাবেই বরাদ্দ কমছে।
নতুন এডিপিতে বরাবরের মতো এবারও নিজস্ব সম্পদের অংশ বেশি থাকছে। এর পরিমাণ ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা, বা মোট বরাদ্দের ৬২ শতাংশ। বাকি ৯৩ হাজার কোটি টাকার জোগান আসবে বিদেশী উৎস থেকে, যা এডিপির ৩৮ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কৃষি, শিল্প ও সমন্বয় উইং) মোঃ ছায়েদুজ্জামান বলেন, আমরা খসড়া এডিপি করেছি। এটা ১৭ মে এনইসি সভায় উপস্থাপন করব। সবার মতামত নিয়ে এটা অনুমোদিত হবে। প্রকল্পের চাহিদা ও বাস্তবায়ন গতি দেখেই টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে এডিপির মাধ্যমে প্রকল্পে বরাদ্দের ক্ষেত্রে ৫২ দফা নির্দেশনা জারি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো, যেসব প্রকল্প আগামী অর্থবছরে শেষ হবে, সেসব প্রকল্পে অগ্রাধিকারমূলক বরাদ্দ মিলবে। জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তুলনামূলকভাবে কম বরাদ্দ পাবে।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন গতানুগতিক ধারায় আছে। গত জুলাই-মার্চ সময়ে সংশোধিত এডিপির ৪৫ শতাংশের মতো বাস্তবায়ন হয়েছে। খরচ হয়েছে ৯৮ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা।