মুজিববর্ষ উপলক্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে জাতির পিতাকে নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শত চেষ্টায়ই ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না।
সোমবার সংসদের বিশেষ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্মারক বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি সাধারণ আলোচনার এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
সাধারণ আলোচনার জন্য সংসদ নেতার প্রস্তাব তোলার নজির নিকট অতীতে নেই। সাধারণত প্রধান হুইপ বা সংসদের জ্যেষ্ঠ কোনো সদস্য উত্থাপন করে থাকেন।
অধিবেশন কক্ষে জাতির জনকের ছবিসহ সংসদের প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় এই প্রস্তাব আনেন। তার প্রস্তাব উত্থাপনের পর তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এদিন আলোচনা করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুহাম্মদ ফারুক খান, আসাদুজ্জামান নূর, মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, সিমিন হোসেন রিমি, অপরাজিতা হক।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনের প্রথম দিন জানিয়েছিলেন, সংসদ সদস্যরা টানা চার দিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করবেন এবং বৃহস্পতিবার প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হবে।
শেখ হাসিনা জাতির পিতার আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরে ১৯৭৫ সালের পনেরই অগাস্ট তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার করার কথা তুলে ধরেন।
“১৯৭৫ সালে তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) হত্যা করা হলো নির্মমভাবে। কত অপবাদ দিয়ে, কত মিথ্যা অপপ্রচর চালিয়ে, কত কিছু বলে এবং তার মৃত্যুর পরে কত রকমের মিথ্যা অপপ্রচার।
“ইতিহাস আসলে মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়। আজকে সেই নাম আর কেউ মুছতেও পারবে না, ইতিহাস মুছতে পারবে না।”
বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমানের স্বীকারোক্তি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “কর্নেল ফারুক বিবিসিতে একটা ইন্টারভিউতে বলেছে যে তিনি (বঙ্গবন্ধু) এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে অনেক অপপ্রচার করেও তার জনপ্রিয়তা এতটুকু কমানো যায়নি। তাই তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য হত্যা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।”
জাতির পিতাকে হত্যার পর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা আন্দোলনে তার অবদানের কথা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধের কথাও বলেন তিনি।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ভাষণের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “১০ই জানুয়ারি ওই কষ্ট করে এসে তিনি যখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বললেন, সেই ঐক্যবদ্ধ তো থাকতে পারে নাই।”
বাঙালিদের উপর বঙ্গবন্ধুর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাসের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ফিদেল কাস্ত্রো তাকে সাবধান করেছিলেন, মিসেস গান্ধী বলেছিলেন যে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে সাবধান।
“উনি বলেছেন, না, এরা আমার দেশের ছেলে, এরা আমার সন্তানের মতো, তারা আমাকে মারবে না, মারতে পারে না। তার সেই বিশ্বাসটা বাঙালি জাতি রাখতে পারল না, অবশ্য একটা মুষ্ঠিমেয় ক্ষুদ্রগোষ্ঠি, এদেশের আপামর জনগণ না।”
সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু চিন্তা করতেন জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, তার স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যটাই ছিল বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
“মাননীয় স্পিকার, আমাদের সব থেকে দুর্ভাগ্য যে বাবা গ্রেপ্তার হয়েছেন,কারাগারে ছিলেন। আমরা তো সন্তান হিসেবে একটানা দু’বছরও বাবার স্নেহ-ভালোবাসা পাইনি। দেখা হয়েছে বন্দিখানায়।”
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করতে বঙ্গবন্ধু কর্মোদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে আত্মপরিচয় দিয়েছেন, একটি রাষ্ট্র দিয়েছেন। তার সেই স্বপ্ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যেই আকাঙ্ক্ষা, আমরা সেই দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব, এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।”
যে প্রস্তাব তোলা হল
সংসদের অভিমত এই যে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি, বাঙালির অবিসংবাদিত মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। জেল-জুলুম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু অন্যায়ের সাথে কখনও আপস করেননি। ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা ১৯৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন- দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার নিরস্ত্র জনগণ ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরে জাতির পিতা শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ মহান শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। লাল-সবুজের পতাকা ও সংবিধান। বঙ্গবন্ধু বিশ্বসভায় বাঙালিকে আত্মপরিচয় নিয়ে গর্বিত জাতিরূপে মাথা উঁচু করে চলার ক্ষেত্র রচনা করেছেন। স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন তিনি। সেই সময়কালে বাংলাদেশের উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন তিনি। ২০২০ সালে জন্মশতবার্ষিকীতে মুজিব বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক এবং কর্মময়জীবন ও দর্শনের উপর জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করা হোক।