নিউজ ডেস্কঃ দেশে ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পৃথক নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক উচ্চপর্যায়ের পর্যালোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় ই-কমার্স ব্যবসার সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। চার মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন।
সভা শেষে প্রেসব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ই-কমার্স নিয়ে আলাদা একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা হবে। ডিজিটাল ই-কমার্স আইন করা হবে। যারা ই-কমার্স ব্যবসা করতে চান, সবাইকে নিবন্ধিত হতে হবে। তিনি বলেন, ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে, মনে হচ্ছে তারা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারবে না। কারণ হয় ইভ্যালি টাকা সরিয়ে নিয়েছে, না হয় বিজ্ঞাপনের পেছনে প্রচুর টাকা খরচ করেছে। তবে ইভ্যালির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকেরা যাতে টাকা ফেরত পান, সরকার সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। একই সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যাতে শাস্তি পায়, সেটিও নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যানকে জেলে পাঠানোই সমাধান নয়। দেশে বর্তমানে ৩০ হাজারের মতো এমন প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২টির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। সার্বিকভাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে খারাপ বলা যাবে না। আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে, গত ৪ জুনের আগে এ খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক নারীও ই-কমার্সে যুক্ত হয়েছেন। তাই ই-কমার্স বন্ধ করা যাবে না।
ইভ্যালির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ইভ্যালির ৫০০ কোটি টাকার দায় রয়েছে। অর্ধেক কাস্টমার, অর্ধেক মার্চেন্টদের। শুনেছি ৮০-৯০ কোটি টাকার সম্পদ আছে। এগুলো আজকের আলোচনায় এসেছে। তিনি বলেন, আমাদের কাজ ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা। কিন্তু তারা যে মানুষকে লোভ দেখাচ্ছে, সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখবে না? ১০০ টাকার জিনিস তারা ৫০ টাকায় দিতে চায়, সেটা কীভাবে সম্ভব? মানুষ লোভ সামলাতে না পেরে ফাঁদে পা দিয়েছে, তাদের লোভ সংবরণ করা উচিত। সরকার টাকার দায় নেবে কি-না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, সরকার তো টাকা নেয়নি। যে লোকটা পাঁচটা মোটরসাইকেল কিনে লাভ করেছে, পরে আরও ১০টা অর্ডার করেছে। লাভের ভাগিদার তো সরকার হয়নি।
একটি সূত্র জানায়, সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ই-কমার্স পরিচালনার জন্য একটি আইন তৈরি করা প্রয়োজন। দেশের কোনো মানুষ যাতে ডিজিটাল বাণিজ্যে প্রতারিত না হন, সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ই-কমার্স বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হবে না। আইনের আওতায় ই-কমার্সকে সুশৃঙ্খল করতে হবে। মানুষ কম দামে পণ্য পেতে চাইবে, এটাই বাস্তবতা। ই-ব্যবসার জন্য জামানত রাখার ব্যবস্থা করা যায়। প্রতারণার বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। মানুষ যাতে টাকা ফেরত পায় সেজন্য সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, মানুষ যাতে প্রতারিত না হন, সেজন্য আইন করা দরকার। এ ব্যবসা পরিচালনার জন্য একটি রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করা যেতে পারে। গুটিকয়েক প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হবে না। রেগুলেটরি অথরিটিকে অত্যাধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে এবং মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
বৈঠকে আরো কিছু সুপারিশ
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বৈঠকে বেশকিছু আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ ই-কমার্স ব্যবসা বন্ধের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছে কয়েকটি খারাপ প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স বন্ধ করা ঠিক হবে না। কিছু সুপারিশ এসেছে, সেগুলো হলো ই-কমার্স ব্যবস্থাপনার জন্য ই-কমার্স রেগুলেটরি কমিটি করতে হবে। ডিজিটাল কমার্স আইন করতে হবে। কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করা হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যাতে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেজন্য আইনে কিছুটা সংশোধনী আনতে হবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন নিতে হবে, নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা করা যাবে না। সভায় চার মন্ত্রী ছাড়াও পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী যা বললেন
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ই-কমার্স খাতে জালিয়াতির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, এগুলো কারো না কারো ছাড়পত্র নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়পত্র নিয়ে ব্যবসা করছে। সুতরাং সংশ্লিষ্টদের দায় নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে মূল কাজটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। তাদেরকে প্রাথমিক দায়িত্ব নিতে হবে
গতকাল ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত এবং সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, মানুষকে ঠকানোর কাজটি আগেও হয়েছে। আগে ম্যানুয়ালি ঠকানো হতো এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঠকানো হচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। সরকার অবশ্যই দায়িত্ব নেবে, যাতে করে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করতে না পারে।
সঞ্চয়পত্রে সুদ হার কমানো প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন ব্যাংক আমানতের সুদ হার কম। তাই বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চয়পত্রে সুদ হার কমানো হয়েছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া, কখনো বাড়বে, কখনো কমবে। নিরুত্সাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ১ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ব্যবস্থা রাখা আছে। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিভিন্ন অফিস ঢাকার বাইরেও করা হবে কি না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বাইরে অফিস করা হবে কি না সেটা অন্য মন্ত্রণালয়গুলো বলতে পারবে। তবে আমরা নাগরিক সুবিধা গ্রামেও নিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে দুটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১৩ কোটি ৮২ লাখ লোককে টিকাদানের লক্ষ্যে ১১ কোটি এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অটো ডিজেবল (এডি) সিরিঞ্জ মেসার্স জেএমআই সিরিঞ্জেস অ্যান্ড মেডিক্যাল ডিভাইসেস লিমিটেড হতে ক্রয়ের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কর্তৃক অতিরিক্ত ৮০ হাজার টন জ্বালানি তেল জরুরি বিবেচনায় জি-টু-জি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটেশন আহ্বানের মাধ্যমে আমদানির প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ক্রয় কমিটিতে ১২ প্রস্তাব অনুমোদন
সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় মোট ১২টি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের চারটি, বিদ্যুত্ বিভাগের তিনটি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের দুটি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রস্তাবনা ছিল।
সভায় বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলায় ৫০ মেগাওয়াট (এসি) ক্ষমতার সোলার বিদ্যুত্ প্রকল্প স্থাপনকাজ যৌথভাবে হিরো ফিউচার এনার্জিস এশিয়া প্রা. লি. সিঙ্গাপুর এবং বিজনেস রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন (বিআরআইসি) পানামা এর কাছ থেকে ক্রয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে ২০ বছর মেয়াদে আনুমানিক ১৩২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, কর ফাঁকি দিতে আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত দেশ পানামা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কি না। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী পরে জানাবেন বলে উল্লেখ করেন।