ডেস্ক নিউজ
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদকে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা হলে খুবই ভালো। বর্তমানে যেভাবে পুঁজিবাজার পরিচালিত হচ্ছে তাতে কমিশনের উদ্যোগ অনেকটাই কার্যকর হচ্ছে। তবে ভালো পুঁজিবাজারের সঙ্গে যেন ভালো কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’
পুঁজিবাজারে ‘পরিণত আচরণ’ নিয়ে বাজার বিশ্লেষকদের মধ্যে আশাবাদের মধ্যে ঈদের পর প্রথম কার্যদিবসের লেনদেন বাজার নিয়ে আস্থার প্রমাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রোববার পুঁজিবাজারে লেনদেন ঈদের আগের দিনের চেয়ে কিছুটা কম হলেও এমন এক ঘটনা ঘটেছে, যা গত এক দশকেও দেখা যায়নি। ২০১১ সালের পর কোনো ঈদের পর সর্বোচ্চ লেনদেন হলো এদিন।
রোববার ঈদের পর প্রথম কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। ঈদের আগের শেষ কার্যদিবসে লেনদেন ছিল ১ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।
এ নিয়ে টানা ১০ কার্যদিবস পুঁজিবাজারে ১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হলো।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা পুঁজিবাজারের আস্থার প্রতিফলন। আমরা দেখেছি, ২০১১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঈদের আগের শেষ কার্যদিবস আর ঈদের পর প্রথম কার্যদিবসে যে লেনদেন হয়, তা গত ১০ বছরে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগে কখনও ঈদের আগে ক্রমাগত হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়নি। আর ঈদের পর প্রথম কার্যদিবসে সূচকের উত্থান থাকলেও হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়নি।’
গত বছরের শেষ দিকে বিএসইসির বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বাজারে দেখা দেয় চাঙাভাব। সক্রিয় হতে শুরু করেন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া বহু বিনিয়োগকারী। প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করার চেষ্টাও চলছে।
গত সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা উত্থানের পর বিএসইসির একটি সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে বিনিয়োগকারীদের খুশি করলেও সেদিনের পর থেকেই কমতে থাকে বাজার।
মার্জিন ঋণের সুদহার ১২ শতাংশ নির্ধারণ করে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আদেশ জারির পর থেকেই বাজার পড়তে থাকে। ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্ট থেকে কমতে কমতে একপর্যায়ে ৫ হাজার ১০০ পয়েন্টের মতো হয়ে যায়।
সূচক কমার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনা বন্ধ করে দেন। ফলে যে বাজারে টানা ১০ কার্যদিবস প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, সেখানে একপর্যায়ে ৪০০ কোটি টাকার নিচে নেমে আসে।
তবে লকডাউন শুরু হওযার আগে আগে বিএসইসি জানায়, মার্জিন ঋণের সুদহার বেঁধে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত চলতি বছর আর এটি কার্যকর হবে না। আবার আনুপাতিক হারে আগের চেয়ে বেশি মার্জিন ঋণ নেয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে।
এসব সিদ্ধান্তের পর গত ৫ এপ্রিল লকডাউন শুরুর পর থেকে বাজারে দেখা দেয় ইতিবাচক মনোভাব। অথচ লকডাউনে লেনদেন বন্ধ থাকবে গুজবে এর আগে টানা কয়েক দিন বড় পতন হয়। এক দিনে সূচক পড়ে পৌনে ২০০ পয়েন্টের বেশি।
এবার ঈদের আগে আগেও পুঁজিবাজারে ছিল চাঙাভাব। অন্যান্য বছর বিনিয়োগকারীরা এই সময় শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নেন। তবে এবার তা হয়নি। বিক্রির চাপ কম থাকায় শেয়ারের দাম বেড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা ব্যাংক, আর্থিক খাত, বস্ত্র, মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে দেখা দেয় চাঙাভাব।
ঈদের পর প্রথম কয়েক দিন সাধারণত শেয়ার কম কিনে বাজার পর্যবেক্ষণে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে কয়েক দিন বাড়ে না সূচক ও লেনদেন।
কিন্তু এবার ঈদের ছুটি শেষে বড় খাতগুলোর মধ্যে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং প্রকৌশল নিয়েও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখা গেছে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারও কিনছেন দ্রুতগতিতে। লকডাউনের কারণে লেনদেন হচ্ছে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। এর মধ্যেই প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার লেনদেন হলো, যদিও বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই এখন ঈদের ছুটিতে।
বিএসইসির কমিশনার শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা চাই বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের প্রতি এই আস্থা ধরে রাখুক। এবং কমিশনও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও কীভাবে সহায়ক ভূমিকা রাখা যায় সে চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদকে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা হলে খুবই ভালো। বর্তমানে যেভাবে পুঁজিবাজার পরিচালিত হচ্ছে তাতে কমিশনের উদ্যোগ অনেকটাই কার্যকর হচ্ছে। তবে ভালো পুঁজিবাজারের সঙ্গে যেন ভালো কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’
ঈদ শেষে লেনদেন খতিয়ান
২০১৬ সালে ঈদের আগে শেষ কার্যদিবস ৮ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছিল ৪৮০ কোটি টাকা। এবং ঈদের পর প্রথম কার্যদিবস ১৮ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছিল ৩১৪ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে ঈদের আগে শেষ কার্যদিবস ৩১ আগস্ট লেনদেন হয়েছিল ৮৫২ কোটি টাকা। এবং ঈদের পর প্রথম কার্যদিবস ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছিল ৬৬৭ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে ঈদের পর ১৮ জুন প্রথম কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছিল ৪৮৫ কোটি টাকা। আর পুঁজিবাজারে ঈদের ছুটিতে যাওয়ার আগে ১২ জুন লেনদেন হয়েছিল ৪৫৭ কোটি টাকা।
গত ৫ এপ্রিল লকডাউন শুরুর পর থেকেই পুঁজিবাজারে চাঙাভাব দেখা দিয়েছে
২০১৯ সালে ঈদের পর ৯ জুন প্রথম কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছিল ৩০৪ কোটি টাকা। ঈদের ছুটিতে যাওয়ার আগে ৩০ এপ্রিল লেনদেন হয়েছিল ৩০৪ কোটি টাকা।
২০২০ সাল দেশের করোনা পরিস্থিতে ঈদুর ফিতরে বন্ধ ছিল পুঁজিবাজারের লেনদেন। তবে চালু ছিল ঈদুর আজহার সময়। ২০২০ সালের ঈদুর আজহার আগের দিন সর্বশেষ কার্যদিবস ৩০ জুলাই লেনদেন হয়েছিল ৫৮০ কোটি টাকা। আর ঈদের পর প্রথম কার্যদিবস ৩ আগস্ট লেনদেন হয়েছিল ৬৭২ কোটি টাকা।
খাতওয়ারি লেনদেনে ফিরেছে আস্থা
এক দশক ধরেই ব্যাংক খাতে নেতিবাচক প্রবণতা চলছে। এর মধ্যে গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাবের পর এই খাতের শেয়ারের দাম একেবারে তলানিতে নেমে আসে।
তখন কথা ছড়িয়েছিল যে, করোনায় ব্যাংকের মুনাফা কমে যাবে এবং লভ্যাংশ পাওয়া যাবে না। তবে বছর শেষে দেখা গেল করোনাকালে মুনাফা বেশি করার পর লভ্যাংশও বেশি দিয়েছে কোম্পানিগুলো।
চলতি বছর ৩১টি ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত যে ২৭টি ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে ২৩টি কোম্পানি ২ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা কেবল নগদে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি আছে বোনাস শেয়ার।
চলতি বছর প্রথম তিন মাসের আয়ও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যে ২০টি ব্যাংক প্রান্তিক ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে ১৫টিই আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি আয় করেছে। একটি ব্যাংক প্রায় তিন গুণ, একটি দেড় গুণ, একটি দ্বিগুণ এবং আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি আয় করেছে।
একই পরিস্থিতি বস্ত্র খাতে। করোনার প্রাদুর্ভাবে এই খাতেও আয় ভালো হবে না ভেবে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারদর অভিহিত মূল্যের আশেপাশে বা তার চেয়ে নেমে গেছে।
প্রান্তিক প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে এবার গত বছরের চেয়ে বেশি আয় করছে অনেক কোম্পানি। তবে এটাও ঠিক যে, এই খাতেই লোকসানি কোম্পানি অনেক।
ঘুমিয়ে থাকা বস্ত্র খাতও ঈদের আগে হঠাৎ একদিন লাফ দিয়ে এরপর দুই দিন স্থিতিশীল থেকে আবার লাফ দেয়।
ঈদের পর প্রথম লেনদেনে সেই আস্থা ধরে রেখে আবারও উত্থানে ফিরেছে ব্যাংক ও বস্ত্র খাতের শেয়ারের।
লকডাউনে যেভাবে বেড়েছে সূচক ও লেনদেন
লকডাউনের শুরুতে আতঙ্ক কাজ করলেও প্রায় এক মাসের লকডাউনে স্বস্তিতে ছিল পুঁজিবাজার। ৫ মে লকডাইন শুরু হওয়ার আগের দিন এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সূচকের পতন হলেও লকডাউন শুরু হওয়ার পর সূচক বেড়েছে। এদিন প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৮৮ পয়েন্ট। ৬ এপ্রিল বাড়ে আরও ১০৩ পয়েন্ট।
৭ এপ্রিল বাড়ে ৫৫ পয়েন্ট।
এদিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারের ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়ার নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়।
এরপর ৮ এপ্রিল ও ৯ এপ্রিল পর্যায়ক্রমে ৮২ পয়েন্ট ও ৯০ পয়ন্টে কমে আসে সূচক।
কিন্তু কেন ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হয়েছে সেটি ব্যাখ্যা আসার পর অনেকটা স্থিতিশীল হয় ১১ এপ্রিল থেকে। শুক্রবার ও শনিবার সরকারি ছুটির পর লেনদেনে সূচক বাড়ে ৯০ পয়েন্ট। তারপর টানা ১০ কার্যদিবস ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত উত্থান ছিল সূচকের।
দুই সপ্তাহ উত্থান শেষে ২৬ এপ্রিল এক দিন বেশ বড় দরপতনই দেখে পুঁজিবাজার। সেদিন সূচক হারায় ৬৩ পয়েন্ট।
এরপর আবার তিন কার্যদিবস যথাক্রমে ৩৯, ১৮ ও ৪১ পয়েন্ট বাড়ার পর এক দিন সূচক কমে ছয় পয়েন্ট।
এরপর দুই-এক দিন উঠানামা হলেও ঈদের আগে টানা বেড়েছে সূচক।
৪ মে থেকে চার কার্যদিবসে যথাক্রমে ২৪, ৫৩, ১৮, ৩৯, ৭৯ ও ২৬ পয়েন্ট বেড়ে ঈদের ছুটিতে যায় পুঁজিবাজার।
লকডাউনের এ সময়ে পুঁজিবাজারে লেনদেন বেড়েছে পাঁচ গুণ। লকডাউন শুরু হওয়ার পর ৫ এপ্রিল পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছিল ২৩৬ কোটি টাকা। ঈদে পুঁজিবাজার বন্ধ হওয়ার আগে ১২ মে লেনদেন হয় ১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এই সময়ে টানা ৯ দিন হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় পুঁজিবাজারে।