ডেস্ক নিউজ
ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ যথাযথ সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধের বেশির ভাগ এলাকা নাজুক হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সুপার সাইক্লোন আম্ফানের তাণ্ডবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়িবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাগরের জোয়ার-ভাটায় ডুবছে-ভাসছে অনেক জনপদ। চরম ঝুঁকিতে আছে উপকূলীয় ২৫ জেলার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। সেই ঝুঁকি মোকাবেলায় নতুন মেগাপ্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাঁধ টেকসই করতে নকশা পরিবর্তন করা হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণেও নেওয়া হচ্ছে নতুন পরিকল্পনা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলেই রয়েছে পাঁচ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার বাঁধ, যার পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। বরং সিডর, আইলা ও আম্ফানের মতো ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। প্রতিটি দুর্যোগের পরই জোড়াতালি দেওয়া হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে কার্যকর উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি। ফলে সাতক্ষীরা-খুলনা-বরিশাল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকা চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর গত ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলের’ আঘাত নিঃসন্দেহে বড় ছিল। তবে গত ২০ মে আম্ফানের আঘাতে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এখনো উপকূলের বহু মানুষ আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি সরেজমিনে দেখতে উপকূলীয় এলাকা সফর করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক, উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম ও সচিব কবির বিন আনোয়ারসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাঁদের দেওয়া প্রতিবেদনে নতুন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মেগাপ্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে আট হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে খুলনার ১৪নং পোল্ডারে ৯৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ও ৩১নং পোল্ডারে এক হাজার ২০১ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং সাতক্ষীরার ৫নং পোল্ডারে তিন হাজার ৬৭৪ কোটি তিন লাখ ও ১৫নং পোল্ডারে ৯৯৭ কোটি ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তা শেষ হবে তিন বছরের মধ্যে।
উপমন্ত্রী শামীম জানান, ওই চারটি প্রকল্পের বাইরে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে আরো কয়েকটি প্রকল্প প্রণয়নের কাজ চলছে। এ ছাড়া বাঁধের সুরক্ষায় কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত সুপার ড্রাইভওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। শুধু বেড়িবাঁধ নয়, পুরো উপকূলের উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের মতো উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠনের বিষয়টিও বিবেচনাধীন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অতীতে বেড়িবাঁধ সংস্কার, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে প্রতিবছর সরকারি কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ হয়নি। তাদের প্রধান দাবি টেকসই বাঁধ। সেই লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের নির্বাহী সদস্য পলাশ আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তুলে ধরা সুপারিশে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায় রেখে উপকূলে স্থায়ী ও মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। যে বাঁধের নিচে ১০০ ফুট, ওপরে ৩০ ফুট এবং উচ্চতা হবে ৩০ ফুট।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় জনগণের সুপারিশ আমলে নিয়ে বেড়িবাঁধ তৈরির ডিজাইনেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বাঁধের উচ্চতা পাঁচ ফুট থেকে বেড়ে ১৩ ফুট এবং চওড়া হবে ১২ ফুট। ঘের নির্মাণে নিষেধাজ্ঞাও কার্যকর করা হবে। উপকূলে নদ-নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা চারটি প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের শেষ নাগাদ শুরু হতে পারে।