দ্রুত যাতায়াতের চিন্তা থেকে দেশব্যাপী এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এতে দেশের পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বাড়বে। বিদ্যমান সড়কে ধীরগতির ও অযান্ত্রিক যানবাহন, অবৈধ হাটবাজারসহ নানা কারণে বিনা বাধায় গাড়ি চলতে পারে না। তা ছাড়া অপ্রশস্ত সড়কের কারণেও অতিরিক্ত যান চলাচলে যানজট সৃষ্টিসহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এ জন্য আটটি কানেক্টিভিটি এক্সপ্রেসওয়ের করিডর হবে। প্রথমে ৩ হাজার ৯৯৩ কিলোমিটার সড়ককে এ করিডরের আওতায় আনতে চাইছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শিগগিরই উপস্থাপন করা হবে ন্যাশনাল এক্সপ্রেসওয়ে কর্মসূচির ধারণাপত্র।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বিভাগীয় শহর, গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর/স্থলবন্দর, প্রধান পর্যটনকেন্দ্রকে সংযুক্ত করার জন্য এক্সপ্রেসওয়ে করিডরের খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নেটওয়ার্কটি দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে। তা ছাড়া এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্কটি কমবেশি সব উপ-আঞ্চলিক এবং আন্তঃদেশীয় মহাসড়ক করিডরে যুক্ত হবে। এ জন্যই আটটি কানেক্টিভিটি করিডর চিহ্নিত করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
বর্তমানে পণ্য পরিবহনের ৮৮ শতাংশ ও যাত্রী পরিবহনের ৮০ শতাংশ সড়কের ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় মহাসড়কের কিছু অংশ চার লেনে এবং কিছু ছয় লেনে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশই দুই লেনবিশিষ্ট। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত গাড়ি চলাচলে যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটছে। এ থেকে উত্তরণেই এক্সপ্রেসওয়ের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার।
সাউথ ইস্ট কানেক্টিভিটির অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে চট্টগ্রামে ও কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত অংশ নিরবচ্ছিন্নভাবে এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে। এর কানেক্টিভিটি করিডরে মোট তিনটি সড়কাংশে প্রস্তাব করা হয়েছে। নর্থ ইস্ট কানেক্টিভিটি হিসেবে ধরা হয়েছে ঢাকা থেকে দেশের উত্তর-পূর্ব অংশ সিলেট হয়ে তামাবিল স্থলবন্দর পর্যন্ত। এ অংশটি এশিয়ান হাইওয়ের রুট ১ ও ২-এর অংশ। এখানে তিনটি সড়ক চিহ্নিত করা হয়েছে। নর্থ অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্ট কানেক্টিভিটি হিসেবে ধরা হয়েছে ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহ, ঢাকার সঙ্গে রংপুর হয়ে বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর এবং ঢাকার সঙ্গে বিভাগীয় শহর রাজশাহী ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর পর্যন্ত অংশ। এ অংশে মোট নয়টি সড়কাংশ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ঢাকা ও দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দেশের উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নত সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাউথ অ্যান্ড সাউথ ওয়েস্ট কানেক্টিভিটি হচ্ছে ঢাকার সঙ্গে যশোর হয়ে বেনাপোল বন্দর, ঢাকার সঙ্গে বিভাগীয় শহর খুলনা হয়ে মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকার সঙ্গে বরিশাল হয়ে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা এবং পায়রাবন্দর পর্যন্ত অংশ। এই কানেক্টিভিটির অংশ হিসেবে মোট ১০টি সড়কাংশ চিহ্নিত করা হয়েছে। সাউথ-সাউথ কানেক্টিভিটির মাধ্যমে প্রস্তাবিত অন্য এক্সপ্রেসওয়ে পায়রাবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম/চট্টগ্রাম বন্দর এবং কক্সবাজারকে সংযুক্ত করবে। নিরবচ্ছিন্ন এক্সপ্রেসওয়ে প্রতিষ্ঠার জন্য এই রুটে মেঘনা নদীতে শরীয়তপুর ও চাঁদপুর জেলাকে সংযুক্ত করে একটি সেতু বা টানেল নির্মাণের দরকার হবে। নর্থ-নর্থ কানেক্টিভিটি হচ্ছে বিভাগীয় শহর রংপুরের সঙ্গে ঢাকা বাদ দিয়ে ময়মনসিংহ হয়ে সীমান্ত সড়ক বরাবর সিলেটকে সংযুক্ত করবে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সংযুক্ত হবে তামাবিল স্থলবন্দরের সঙ্গে। এই কানেক্টিভিটি বাস্তবায়নে যমুনা নদীর ওপর জামালপুর-গাইবান্ধা সংযোগকারী একটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে। ঢাকা সার্কুলার রুট নামে এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে ঢাকা শহরের চার পাশে তিনটি বৃত্তাকার পথ প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকা শহরের যানজট এড়িয়ে এবং ঢাকাকে পরিহার করে দেশের অন্য বিভাগীয় শহরগুলোয় যান চলাচল করতে পারবে। আরেকটি কানেক্টিভিটির নাম নর্থ সাউথ কানেক্টিভিটি। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরকে মোংলা বন্দরের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে যুক্ত করবে এটি। কানেক্টিভিটি স্থাপন করা হলে মোংলা বন্দরের সঙ্গে বাংলাবান্ধা এবং বুড়িমারী স্থলবন্দরের ‘সর্টেস্ট রোড ডিসট্যান্স’ প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর ওপর পাবনা-রাজবাড়ী সংযোগকারী একটি সেতু নির্মাণের প্রয়োজন হবে।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর বলেন, মহাসড়কে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত যান চলবে। তা ছাড়া হাটবাজার-অবৈধ স্থাপনার মতো বিষয় সেখানে রইল না। যেতে পারবে না পথচারী। এ রকম নানা কারণেই এক্সপ্রেসওয়ে দরকার।
সূত্রমতে, ইতোমধ্যে বিদ্যমান মহাসড়কের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জন্য দ্রুতগামী সড়কের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত মহাসড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। ফলে প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলবে ৮০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে; বর্তমানে ঘণ্টায় তা মাত্র ২৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। তা ছাড়া এর মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে করিডরে সম্পৃক্ত হবে দেশ। অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্পাঞ্চল, বন্দরনগর বিবেচনায় নিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে আওতাভুক্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, পণ্য পরিবহন এখন সবচেয়ে কঠিন সমস্যা। উপযুক্ত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় কনটেইনার ডিপো, স্টেশন এবং লজিস্টিক পার্ক ইত্যাদির সমন্বয়ে এক্সপ্রেসওয়ে করবে সওজ। কারণ দেশে পরিবহন খরচ জাপান, চীন ও ভারতের তুলনায় বেশি। এর বড় কারণ মহাসড়কের বিদ্যমান সমস্যা। লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই) অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্কোর ২.৩৯ (৫-এর স্কেলে), যেখানে জাপান, চীন ও ভারতের স্কোর যথাক্রমে ৪.২৫, ৩.৭৫ ও ২.৯১ পয়েন্ট। তা ছাড়া সাধারণ মহাসড়ক অপেক্ষা এক্সপ্রেসওয়ে অধিক নিরাপদ। ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেমের (আইটিএস) সাহায্যে কার্যকর যানবাহন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু হ্রাস করা সম্ভব। আইটিএসের মাধ্যমে কোন পথে গাড়ি বেশি চলছে, কোন গাড়ি অতিক্রম করছে, কোথায় দুর্ঘটনা ঘটল তার সবই রেকর্ডভুক্ত থাকে। এক্সপ্রেসওয়ের মূল লেন থেকে ধীরগতির যানবাহন ও পথচারী চলাচল লেন পৃথককরণের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থা আরও গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা কমবে।
এক্সপ্রেসওয়ের মানদ- ও স্পেসিফিকেশন হিসেবে সওজ বলছে, এশিয়ান হাইওয়ের আওতায় এক্সপ্রেসওয়েকে প্রথম শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত এই মহাসড়কের আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালিত। এতে থাকবে চার বা তারও বেশি লেন। সেখানে পথচারী ও ধীরগতির গাড়ি চলতে পারবে না। সমতল স্থানে যানবাহনের ডিজাইন স্পিড ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার, ঢাল অঞ্চলে ১০০ কিলোমিটার এবং পাহাড়ি অঞ্চলে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে প্রবেশ ও বহির্গমনের জন্য ইন্টারচেঞ্জ, শহরাঞ্চল ও বাণিজ্যিক অঞ্চল অতিক্রমের ক্ষেত্রে ফ্লাইওভার, টোলপ্লাজা, বিশ্রাম এলাকা, আন্ডারপাস, শব্দ প্রতিবন্ধক এবং ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম। সেখানে ইলেকট্রনিক টোল ব্যবস্থাপনা এবং যানবাহনের জন্য অগ্রিম তথ্যের পূর্বাভাস মিলবে। এক্সপ্রেসওয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে ৩২টি রুটে বিভক্ত করে একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুত করেছে সওজ। ৩ হাজার ৯৯৩ কিলোমিটার হিসাব করা হয়েছে মহাসড়কগুলোর রুটের দৈর্ঘ্য বিবেচনায়। প্রথমেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, কক্সবাজার-টেকনাফ, কাঁচপুর-সিলেট, সিলেট-তামাবিল, সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ময়নামতি, ঢাকা এয়ারপোর্ট-জয়দেবপুর বিআরটি করিডর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন, জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-বগুড়া-রংপুর, রংপুর-পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা, রংপুর-বুড়িমারী, হাটিকুমরুল-নাটোর-রাজশাহী, রাজশাহী-নবাবগঞ্জ- সোনামসজিদ স্থলবন্দর, বগুড়া-নাটোর, গাবতলী-নবীনগর-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া-মাগুরা-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা, বনপাড়া-পাকশী-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ, ঢাকা-মাওয়া, পদ্মা সেতু-গোপালগঞ্জ-খুলনা, খুলনা-মোংলা, ফরিদপুর-বরিশাল, বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা, ভাঙা-নড়াইল-যশোর, যশোর-বেনাপোল, হাটিকুমরুল-নগরবাড়ী-রাজবাড়ী, জয়দেবপুর-ভুলতা-মদনপুর (ঢাকা বাইপাস), ঢাকা ইনার সার্কুলার রুট, ঢাকা মিডেল সার্কুলার রুট, ঢাকা আউটার সার্কুলার রুট, সিলেট-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ-শেরপুর-দেওয়ানগঞ্জ-গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী ও মাদারীপুর-শরীয়তপুর-ভেদরগঞ্জ-চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর-চৌমুহনী-ফেনী।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় এক্সপ্রেসওয়ে কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে- টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা, নির্ভরযোগ্যতা এবং গতিশীলতা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া পরিবহন খরচ কমানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে। সবচেয়ে বড় কথা- সমুদ্রবন্দর, নদীবন্দর, স্থলবন্দর এবং অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে সমন্বিত বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে।