ডেস্ক নিউজ
মার্চের বেতন ও বৈশাখী ভাতায় বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ বেড়েছে
দর্জিপাড়ায় কারিগরদের দম ফেলার সময় নেই
বৈশাখ ও ঈদ ঘিরে রাজধানীর মার্কেট, বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলোতে নগরবাসীর কেনাকাটার ধুম শুরু হয়েছে। রোজার মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবছর ঈদের কেনাকাটা শুরু হলেও এবার রমজানের শুরুতে মার্কেট ও ফ্যাশন হাউসগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগামী ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালিত হবে সারাদেশে। এর দুসপ্তাহ বাদে রয়েছে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। মূলত এই দুই উৎসব ঘিরে জমে উঠেছে সব ধরনের কেনাকাটা। তাদের ধারণা এবার রেকর্ড কেনাকাটা হবে। এছাড়া গত দুই বছরে করোনা মহামারীতে নানান বিধিনিষেধে ঈদ ও নববর্ষে মার্কেটে ক্রেতা তেমন আসেননি। কিন্তু এবার করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় মানুষের মধ্যে ভীতি কেটেছে। তাই সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে আগেভাগেই কেনাকাটা শুরু করেছেন। বিশেষ করে দর্জিপাড়ায় পোশাক-আশাক বানানোর ধুম পড়ে গেছে। থান কাপড় কিনে সবাই ছুটছেন নগরীর অভিজাত দর্জিপাড়ায়।
জানা গেছে, সরকারী চাকুরেদের পাশাপাশি বেসরকারী খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা গত মার্চ মাসের বেতন পেয়েছেন। আগামী ১০ এপ্রিলের মধ্যে বৈশাখী ভাতা পাবেন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়া কয়েক বছর ধরে বেসরকারী খাতের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পহেলা বৈশাখের ভাতা দেয়া শুরু করেছে। এ অবস্থায় চলতি মাসের শুরু থেকে দেশে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। মানুষজন মার্কেটে কেনাকাটার জন্য ছুটছেন। কিনে আনছেন পছন্দের জামা, কাপড়, শাড়ি, থ্রি পিসসহ যাবতীয় পোশাক-সামগ্রী। রাজধানীর প্রধান প্রধান বিপণি বিতানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র কেনাকাটার জন্য ভিড় করছেন নগরবাসী। ঢাকার নিউমার্কেট, গাউসিয়া এবং বসুন্ধরা শপিংমলে গিয়ে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি দোকানে ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। রাজধানীসহ দেশব্যাপী কেনাকাটায় বইছে অনেকটা বৈশাখী ঝড়। বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও আকর্ষণীয় অফার দিয়ে দেশী ও বিদেশী ফ্যাশন হাউসগুলো হুলুস্থূল ফেলে দিয়েছে। তরুণ-তরুণী, কিশোর, বৃদ্ধা সবাই বৈশাখী কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
পহেলা বৈশাখ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছে শপিংমল, ফ্যাশন হাউস ও বিপণিবিতানগুলো। বাদ পড়ছে না ফুটপাথও। বাংলার আবহে তৈরি ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শার্ট, থ্রিপিস ও শাড়ির পসরা সাজিয়ে বসছেন দোকানিরা। আগামী সপ্তাহে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করবে বাঙালী জাতি। যে কারণে বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এ দিনটি উদ্যাপন উপলক্ষে ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি শেষ করে বেচাবিক্রিও শুরু করেছেন। আর ঝামেলা এড়াতে ক্রেতারা ইতোমধ্যে তাদের পছন্দসই পণ্য কিনতে ভিড় করছেন রাজধানীর অভিজাত মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাথের দোকানগুলোতে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, পহেলা বৈশাখ ও ঈদ সামনে রেখে এবার আগেভাগে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এ কারণে মার্কেট ও শোরুমগুলোতে নতুন সব বাহারি পোশাক-আশাকে ভরে উঠেছে। বেচাবিক্রিও ভাল। তিনি বলেন, গত দুবছর করোনার কারণে মার্কেট জমেনি। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ইতোমধ্যে নগরীর সাধারণ মানুষ কেনাকাটার জন্য ভিড় করছেন শোরুমগুলোতে। বেচাবিক্রি ভাল হচ্ছে। গাউছিয়া, চাঁদনী চক আর নিউমার্কেটে দোকানিদের ব্যস্ততা ছিল আরও বেশি। মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা যায় সব বয়সী নারীই এই মার্কেটগুলোতে ভিড় জমিয়েছেন। তবে এর মধ্যে থান কাপড়, শাড়ি আর অলঙ্কারের দোকানেই ক্রেতাদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। বিক্রেতারা জানান, এখানে প্রতিদিন ক্রেতা বাড়ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের উপস্থিতিতে তারা সন্তুষ্ট। একই অবস্থা মৌচাক মার্কেটেও। এখানে থ্রিপিস, শাড়ি, গয়না, বোরকা আর শিশুদের কাপড়ের দোকানে ভিড় লক্ষণীয়। বেইলি রোডের ইয়েলো, আর্টিসান, সাদাকালো, অঞ্জনস ছাড়াও নাভানা মার্কেটের সব দোকানেই ভিড় করছেন ক্রেতা। তবে এবার দাম নিয়ে তাদের অভিযোগ রয়েছে। শান্তিনগর থেকে আসা আফরোজা আক্তার জানান, করোনা শুরুর আগে কাপড়ের যে দাম ছিল তা এখন বেড়েছে। তিনি বলেন, সব জিনিসের দাম বাড়লেও আয় না বাড়ায় সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্রেতাদের ভিড়ে বাদ যায়নি টুপি, আতর-জায়নামাজের দোকান। বায়তুল মোকারমের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, রমজান আসতেই তাদের দোকানগুলোতে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতা আসছেন। ঈদ সামনে রেখে বিক্রি বেড়েছে অনেকগুণ। এদিকে মগবাজার আড়ংয়ে গিয়ে দেখা যায় বাইরে থেকেই লাইন দিয়ে প্রবেশ করছেন ক্রেতা। ভিতরে শাড়ি, থ্রি-পিস, গয়না, পাঞ্জাবি আর বৈশাখের পোশাক কিনতে সবাই ব্যস্ত। আড়ংয়ের একজন বিক্রয়কর্মী জানান, বৈশাখ ও ঈদ কাছাকাছি হওয়াতে ক্রেতাদের এমন চাপ বেড়েছে। এছাড়া পহেলা বৈশাখের কেনাকাটা বাড়াতে অধিকাংশ মার্কেট ও বিপণিবিতান ক্রেতা আকর্ষণে দিচ্ছে মূল্য ছাড়, গিফটসহ নানা অফার। ক্রেতারা মূল্য ছাড়ের সুযোগ নিয়ে কেনাকাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, পহেলা বৈশাখের কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক দিক বেশি।
দর্জিপাড়ায় পোশাক বানানোর ধুম ॥ ঈদকে সামনে রেখে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজধানীবাসী। নতুন পোশাক আর হরেক রকমের কেনাকাটায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে শহরজুড়ে। আর অনেকেই পছন্দের কাপড় কেনাকাটা শেষে তা বানাতে এখন ভিড় জমাচ্ছেন দর্জির দোকানগুলোতে। রাজধানীতে দর্জির দোকানগুলোতে যন্ত্রের শব্দ যেন জানান দিচ্ছে ঈদ আসতে আর দেরি নেই। শব-ই-বরাতের পর থেকেই নতুন পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন দর্জিপাড়ার কারিগররা। ঈদের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চলবে তাদের এই ব্যস্ততা। রোজার প্রথম দিকে কাজের চাপ কম থাকলেও এখন দিন-রাত দর্জিপাড়ার কারিগরদের চোখে যেন ঘুম নেই। এই কারিগররা তাদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নানা নক্সার পোশাক তৈরিতে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কারও সঙ্গে কারও কথা বলারও ফুরসত নেই। কারও গলায় ফিতা, কারও হাতে কাঁচি আবার কেউবা জামা সেলাই করছেন। যেন দম ফেলারও সময় নেই তাদের। গ্রাহকদের মাপ অনুযায়ী সালোয়ার, কামিজ, শার্ট, প্যান্ট ও পাঞ্জাবি তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য মজুরির বিনিময়ে তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। অনেকে নিজেদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে করতে পারছেন না ঈদের কেনাকাটা। পোশাক তৈরির এই উপার্জন দিয়ে সংসার চলে তাদের। ‘দর্জিপাড়া’ খ্যাত রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর রমনা ভবন, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, গাউসিয়া, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও মিরপুরের বিভিন্ন টেইলার্সে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কাপড় তৈরি কারিগরদের এখন দম ফেলার সময় নেই। কাপড় সেলাইয়ের মেশিনের শব্দ একটানা একঘেয়ে, নাকি ছন্দময় তা চিন্তারও সুযোগ নেই তাদের। বাংলাদেশ ড্রেস মেকার এ্যাসোসিয়েশনের সূত্র মতে, রাজধানীসহ সারাদেশে তালিকাভুক্ত লক্ষাধিক টেইলার্স রয়েছে। তবে মান ভাল টেইলার্সের সংখ্যা হবে হাজারের মতো। বাকি ৭৫ হাজার অতি সাধারণ মানের এবং ছোট পরিসরের। পোশাক কারিগররা জানিয়েছেন, সারা বছরে যে কাজ করেন তার চেয়ে দ্বিগুণ কাজ করতে হয় বিভিন্ন উৎসবে। বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে তারা সারা বছরের চেয়ে বেশি উপার্জন করেন। যখন অতিরিক্ত গ্রাহক আসে তখন অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দিলেও গ্রাহকরা তা শুনতে চান না। কারণ এত পোশাক তৈরি করে তারা নির্দিষ্ট সময়ে দিতে পারবেন না। নতুনদের ফিরিয়ে দিলেও পুরনোদের ক্ষেত্রে তা পারেন না। কারণ তারা তাদের সারা বছরের বাধা গ্রাহক। অনেক কারিগর আছেন ঈদের দিনেও পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। এমন পরিস্থিতির ভেতর থেকে তারা ঈদের দিনেও যেতে পারেন না বাড়িতে। ঈদ কাটানো হয় না প্রিয়জনদের সঙ্গে। অন্যের নতুন পোশাক তৈরির মাধ্যমেই তারা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। বেশিরভাগ কারিগর ঈদের পরের দিন বাড়িতে যান। এ প্রসঙ্গে নূর ম্যানশনের মুনমুন টেইলার্সের কারিগর চঞ্চল ভৌমিক জনকণ্ঠকে বলেন, পবিত্র শব-ই-বরাতের পর থেকেই অর্ডার নেয়া শুরু করি। গতবারের চেয়ে এইবার অর্ডার বেশি আসছে। খিলগাঁও তিলপা পাড়ার খাঁন টেইলার্সের মালিক জাভেদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, শব-ই-বরাতের পর থেকে তার দোকানে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। এখন প্রতিদিন অর্ডারের সংখ্যা বাড়ছে।
১০ এপ্রিলের মধ্যে নববর্ষ ভাতা ॥ আগামী ১০ এপ্রিলের মধ্যে নববর্ষ ভাতা পাচ্ছেন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর এই ভাতা দেয়া হচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশে দুটি উৎসব ভাতার প্রচলন ছিল। মুসলমান চাকরিজীবীরা ঈদে এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসবের সময় এসব ভাতা সুবিধা পেতেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি ভাতার পরিমাণ এক মাসের মূল বেতনের সমান। ধর্ম নির্বিশেষে একসঙ্গে সবাইকে উৎসবের আমেজ দিতে নতুন বেতন কাঠামোতে প্রথমবারের মতো নববর্ষ ভাতা চালু করে সরকার। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগ-১-এর এক আদেশে বলা হয়েছিল, জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫-তে বাংলা নববর্ষ ভাতা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সব কর্মচারী (সামরিক ও বেসামরিক) প্রতিবছর মার্চ মাসে আহরিত মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা পাবেন। ফলে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষক ও বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত প্রায় ২০ লাখ চাকরিজীবী ও পেনশনার এবং পারিবারিক পেনশনাররা এখন বৈশাখী ভাতাও উত্তোলন করছেন। এর মাধ্যমে নববর্ষে কেনাকাটা করা এখন সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। সরকারী চাকরিজীবীদের পাশাপাশি বর্তমান বেসরকারী খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানেও পহেলা বৈশাখের ভাতা দেয়া হয়। এর ফলে পহেলা বৈশাখের আগে বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়ে।