ডেস্ক নিউজ
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেসব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে। দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কমছে। সবমিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।
পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার হিড়িক পড়েছে। গত আগস্টে ৭১৮ কোটি ৪০ লাখ (৭.১৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৬১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিশাল অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা খরচ দেখা যায়নি।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) হিসাবে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই দুই মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য ১ হাজার ২১৩ কোটি (১২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল ৮১৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এলসি।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেসব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে। দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কমছে। সবমিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।
সে চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোমে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সে কারণেই শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানিই বেড়ে গেছে; বাড়ছে এলসি খোলার পরিমাণ।
এ ছাড়া বিশ্ববাজারে, জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অন্য সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এলসি খুলতে বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে বলে জানান তারা।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৪ কোটি (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিলেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার এলসি খোলার সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট সময়ে এলসি খুলতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে; সেটা ৪৪৭ কোটি ৪৮ লাখ (৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলার। আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ৫০ শতাংশ বেশি।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে; বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৯৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
অন্যান্য শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৩৮ কোটি ৯০ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৪৯ শতাংশ।
এ ছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬২ শতাংশ।
খাদ্যপণ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৪৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। বেড়েছে ৬৩ শতাংশ।
মহামারির এই কঠিন সময়ে পণ্য আমদানির এলসি বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দেড় বছর ধরে দেশে করোনা মহামারি চলছে। ধীরে ধীরে সব দেশেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। ওই সংকটকালে সবাই জীবন বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। নতুন বিনিয়োগ-ব্যবসা, বাণিজ্য-উৎপাদন নিয়ে খুব একটা ভাবেননি শিল্পোদ্যোক্তারা।
‘কেননা শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা বিশ্বই মহামারির কবলে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। এখন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দেশেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সেসব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছে। সে সব পণ্যের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগের ছক আঁকছেন। আর সে কারণেই আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
‘এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো’ মন্তব্য করে আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেরিতে হলেও বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও টিকাদানে গতি এসেছে। সবার মধ্যে এখন সাহস সঞ্চার হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
‘সবকিছু হিসাব-নিকাশ করে ছোট-বড় সব উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। আর এসব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘করোনাকালে সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য মজুদ বাড়াতে সরকার চাল আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও প্রচুর চাল আমদানি হচ্ছে। সে কারণে চাল আমদানিতে বেশি খরচ হচ্ছে।’
তবে, পণ্য আমদানির নামে অন্য কিছু আমদানি হচ্ছে কি না, আমদানির আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না-সে বিষয়গুলো কড়া নজরদারিতে রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন মির্জ্জা আজিজ।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকে এখন আমরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এইতো মাত্র আমি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করে ফিরলাম।
‘বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের পোশাকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আগামী দিনগুলাতে আমাদের জন্য সুদিন মনে হচ্ছে। যে সব উদ্যোক্তা এতদিন অপেক্ষা করছিলেন, কি হবে, কি হবে…? তারা এখন নতুন ছক কষে, নতুন উদ্যোগে মাঠে নেমেছেন। সে কারণেই অন্য সব পণ্যের সঙ্গে আমাদের শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের আমদানিও বাড়ছে।’
‘ইতোমধ্যে আমরা করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে শুরু করেছি। খুবি শিগগির আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারব বলে মনে হচ্ছে।’
২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৫৬ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, যা ছিল আগের (২০১৮-১৯) অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ২১ শতাংশ কম।