ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ
কোভিড-১৯ এর বিপর্যয় দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল যোগাযোগের সম্ভাবনাগুলোকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে লকডাউনের সময় ঘরে বসে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মহামারির প্রথম ধাপে দুর্যোগ প্রতিরোধের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ডিজিটাল ক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের সুফল হিসেবে অবিচ্ছিন্নভাবে সেবা প্রদান করেতে সক্ষম হয়েছে অনলাইনে। ফলে, ই-পরিসেবার মাধ্যমে শিক্ষা, প্রত্যন্ত কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার কার্যক্রম চালিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে বিভিন্ন দেশ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো, করোনাভাইরাসের বিপর্যয় রোধ করার ব্যবস্থা হিসাবে জনগণের চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপের সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন পরিষেবাদি অনলাইনে প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ডিজিটাইজেশন সম্পর্কিত উন্নত অবকাঠামো থাকার কারণে উন্নত দেশগুলোতে অনলাইনে সেবা প্রদানের অভিজ্ঞতা হয়ত অনেক ভাল ছিল। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ খুব বেশি পিছিয়ে নেই। স্বাভাবিকভাবেই, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান কার্যক্রমের বাস্তবায়নের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং ডিজিটাল পরিষেবা ব্যবহার সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক দেশবাসীর সচেতনতার অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ই-সেবা সম্পর্কিত বিপুল চাহিদা পূরণ করা সরকারের পক্ষে একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হওয়ায় সরকার কোভিড-১৯ এর মাধ্যমে সৃষ্ট ‘‘নিউ নরমাল’’ জীবনযাত্রা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ শক্ত ভাবেই গ্রহণ করেছে। মহামারি চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন পরিষেবাকে অনলাইনে রূপান্তর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনার আলোকে সরকার বিভিন্ন নীতি ও কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে।
সকল পরিসেবার ডিজিটালাইজেশন করার প্রয়োজনীয় সমস্ত কৌশল এখনও বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও, সরকার বিভিন্ন সেবা প্রদানের ব্যবস্থাকে অনলাইনে রূপান্তর করতে প্রকৃতপক্ষে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা যদি বিভিন্ন সেক্টরের দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটালাইজেশনের অবস্থা বিশ্লেষণ করি তবে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার প্রায় প্রতিটি খাতে তার লক্ষ্য অর্জন করতে শুরু করেছে। কৃষকরা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে এবং কৃষি বিভাগের অনলাইন গ্রাহক পরিষেবার মাধমে কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাচ্ছেন । এমনকি তারা অ্যাপ ব্যবহার করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে আপডেট পেতে শুরু করেছে।
অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরেনের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নত হয়েছে। এখন, সাধারন জনগণ ই-পাসপোর্টের আবেদন ফর্ম পূরণ; আবেদন ফি প্রদান এবং আবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময়সূচী নির্ধারণের কার্যক্রম নিজ বাড়িতে বসেই করতে পারে। ব্যাংকিং পরিষেবার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে। মানুষ এখন তাদের ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম অনলাইনে সম্পাদন করতে পারে। বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মতো টেলিফোন ব্যাংকিং মানুষের জীবনকে খুব সহজ করে তুলেছে। আজকাল, টেলিফোন ও বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সকল পরিষেবার বিল পরিশোধের জন্য জনগণকে লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। এই বিল ঘরে বসে অনলাইনে এবং টেলিফোন ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া যায়।
ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। সামাজিক নেটওয়ার্ক একটি প্রভাবশালী নেটওয়ার্কিং মাধ্যম হয়ে উঠেছে যা জাতীয় এবং আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক অঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। ফলে, আমাদের দেশের জনগণ বিভিন্ন দেশের নাগরিকের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারছে। মানুষ এখন ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে বিদেশে বসবাসরত তাদের আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে ভিডিও কলের মাধমে কথা বলতে পারছে যা দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব এনেছে।
কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্র সমাজ, কারণ ১৮ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘায়িত একাডেমিক ক্যারিয়ারের চিন্তায় শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা গভীরভাবে হতাশগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, এটিও আশঙ্কা করা হচ্ছে যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার বাড়তে পারে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে । এমনকি, অনেক শিক্ষার্থী নষ্ট হয়ে যেতে পারে কারণ আমরা জানি যে ‘‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডা’’। তবে, অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। শিক্ষার্থীদের এই অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে সরকারের একটি কৌশল হলো সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা। এ কথা ঠিক যে, এই কৌশলটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তবে শিক্ষার্থীদের তাদের শিক্ষক এবং একাডেমিক পরিবেশের সাথে যোগাযোগ রাখতে এই কৌশল সহায়তা করবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
সরকারের নেতৃত্বে, বেসরকারি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কেরিয়ার বাঁচাতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরচালনা করছে। এই জাতীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করা খুব সহজ কাজ ছিল না কারণ এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ । স্বল্প মূল্যের ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার জন্য সরকার বিভিন্ন ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহকারীদের সাথে আলোচনা করে চলেছে যা শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত থাকতে সাহায্য করেছে। বিটিসিএল একটি বিশেষ সিম কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খুব স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখনও বেশ চিন্তায় রয়েছে কারন তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে পারছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইন ও নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতার কারণে অনলাইন পরীক্ষা নিতে পারছে না। কিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, দেশে ডিজিটাইজেশনের বিকাশের প্রশংসা করতে হবে যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ে ভর্তি প্রক্রিয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনলাইনের মাধমে পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকার প্রথম ধাপের কোভিড-১৯ সংক্রমণ শীর্ষে থাকাকালীন সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি সফলভাবে সম্পূর্ণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ভর্তি সংক্রান্ত সমস্ত কার্যক্রম আজকাল অনলাইনে পরিচালিত হয়। এটি কেবল শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ থেকেই রক্ষা করবে না বরং বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত অভিভাবকদের ব্যয়ের চাপ কমাচ্ছে।
এমনকি মহামারি চলাকালীন সময়ে আইসিটি বিকাশের কারণে অনলাইন বিপণন শিল্পটি বেশ দ্রুত সম্পসারিত হয়েছে। লকডাউনের সময়ে অনলাইন ব্যবসায় লেনদেনের পরিমাণ আগের যে কোন সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। মানুষ আজকাল অসংখ্য অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য কেনা-বেচা করে। এটি কেবল আমাদের জীবন যাপনই সহজ করে নি, বরং ট্যাক্স এবং ভ্যাট আকারে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করার সুযোগ তৈরি করেছে সরকারের জন্য।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার পাশাপাশি, কোভিড-১৯ মহামারি বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান এবং অর্থনৈতিক গতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং, এই জাতীয় জটিল পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হলে সেবা প্রক্রিয়াকে অনলাইনে রূপান্তর করা ছাড়া সরকারের নিকট অন্য বিকল্প ছিল না। ফলে, বিভিন্ন ধরনের সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে মানুষের জীবন যাপন অনেক সহজ হয়েছে মহামারিকালীন সময়ে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টার নির্দেশেনায় নিরলসভাবে কাজ করার ফলে সরকারের পক্ষে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজ হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ করেছিল তার ফল জনগণ পেতে শুরু করেছে মহামারিকালীন সময়ে। তবে, ডিজিটাইজেশনের সর্বোচ্চ সুবিধাটি পেতে হলে আরও প্রচেষ্টা এবং সময় প্রয়োজন। আর এ লক্ষে সরকার ও জনগণকে অবশ্যই সঠিক পথে চলতে হবে। আমরা যদি কোভিড-১৯ মহামারিটি সফলভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি, তবে সেই দিন খুব বেশি দূরে নয় যে দিন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ডিজিটাইজেশনের রোল মডেল হিসাবে বিবেচিত হবে। আর এই কৃতিত্বের একমাত্র দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার।