ডেস্ক নিউজ
দেশের ৩ হাজার ৮৯৩টি রাইস মিলকে কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। এগুলো সরকারের সঙ্গে চুক্তি করার পরও ধান-চাল সরবরাহ করেনি। এ কারণে বর্তমান বোরো মৌসুমে চলমান খাদ্যশস্য সংগ্রহ কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
তাদের মতে, চালের বাজার অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যেই মিলাররা এ ধরনের অপকর্ম করে থাকেন। এতে চালের দাম বাড়িয়ে অল্প সময়ে ভোক্তার পকেট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত চলমান অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কার্যক্রম সংক্রান্ত সভায় চুক্তি ভঙ্গ করা মিলগুলো চিহ্নিত করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিলগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চিহ্নিত রাইস মিলের মধ্যে ৩ হাজার ৮০৫ হাস্কিং (সনাতন পদ্ধতি) এবং ৮৮টি অটো মিল রয়েছে।
চিহ্নিত হাস্কিং মিলের মধ্যে রাজশাহী জোনে ১ হাজার ২৩৭টি, রংপুরে ১ হাজার ৪০০, ময়মনসিংহে ৩২১, চট্টগ্রামে ১০৫, খুলনায় ৬০৮, ঢাকায় ১০৪, সিলেটে ১৯ এবং বরিশালে ১১টি রয়েছে।
মিলগুলো কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে লাইসেন্স বাতিল, জামানত বাজেয়াপ্তসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে তারা আর কোনো সরকারি বরাদ্দ পাবে না।
জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক রায়হানুল কবীর যুগান্তরকে বলেন, ৩১ আগস্ট সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরপর চূড়ান্তভাবে মিলারদের তালিকা করা হবে, যারা এই কর্মসূচিতে চাল দেননি।
এ বিষয়ে মাঠপর্যায় থেকে রিপোর্ট নেওয়া হবে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিশেষ করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, চুক্তি ভঙ্গ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সরকার খাদ্যসামগ্রী সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে মিল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এসব মিল মালিক চাল না দিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মোট ১৮ লাখ টন ধান ও চাল কেনার সিদ্ধান্ত হয়।
এর মধ্যে মিলারদের কাছ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৩৯ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল এবং কৃষকদের কাছ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৬ লাখ টন ধান কেনা হবে।
২৮ এপ্রিল থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে। ২৫ আগস্ট পর্যন্ত চলতি বোরো মৌসুমে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ১৪৫ টন ধান, ৯ লাখ ৫৪ হাজার ১৪০ টন সিদ্ধ চাল এবং ৭৬ হাজার ৬৮১ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া ১ লাখ ৩ হাজার ২১২ টন গম সংগ্রহ করা হয়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সম্প্রতি সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেছেন খাদ্যমন্ত্রী নিজেই। বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী সময়মতো চাল প্রদানে ব্যর্থ মিল মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
ওই বৈঠকে চিহ্নিত মিলগুলোকে আগামী দিনে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচিতে কোনো বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এছাড়া পুঁজি শূন্য, দেউলিয়া হয়ে গেছে, প্রায় বন্ধ বা সম্পূর্ণ বন্ধ-এমন অনেক মিল আছে, যারা তথ্য গোপন করে সরকারের সঙ্গে ধান-চাল দেওয়ার চুক্তি করেছে।
তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি খাদ্যের অবৈধ মজুতকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ হয়েছে।
জানা যায়, সরকারকে ধান-চাল না দিয়ে বেশি দামে বাজারে বিক্রি করেছেন মিল মালিকরা। এতে চালের দাম অনেক বেড়েছে।
এক বছরের ব্যবধানে নাজির ও মিনিকেট চালে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পাইজাম চালে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং মোটা, স্বর্ণ চালে বেড়েছে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চালের আমদানি শুল্ক হ্রাস করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আমদানির। সূত্রমতে, সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েও রাজশাহীতে ১ হাজার ২৩৭টি মিল ধান-চাল দেয়নি।
এ বিভাগে সংগ্রহের আওতায় ৩৯ হাজার ২ টন ধান, ১ লাখ ৬৬ হাজার ১৬৮ টন সিদ্ধ চাল এবং ৪ হাজার ৬০৯ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
জানতে চাইলে রাজশাহীর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জিএম ফারুক হোসেন পাটোয়ারি যুগান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার শেষ হবে সরকারের অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচি।
এরপর যারা ধান-চাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট রাইস ও হাস্কিং মিল মালিকদের চিঠি দিয়ে জবাব চাওয়া হয়েছে।
তাদের পরিষ্কার বলা হয়েছে, চুক্তি করেও যারা সরকারকে ধান-চাল সরবরাহ করেনি, তাদের লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করা হবে।
রংপুর জোনে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেও ১৪শ হাস্কিং এবং ৭টি অটো রাইস মিল কোনো চাল ও ধান দেয়নি। ১ আগস্ট পর্যন্ত এ বিভাগে ধান সংগ্রহ হয় ৭৭ হাজার ২৯৫ টন, সিদ্ধ চাল ১ লাখ ৯২ হাজার ৪৩২ টন এবং আতপ ৫ হাজার ৪৩৫ টন।
রংপুরের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আবদুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, যারা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে ধান-চাল দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংগ্রহ কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আরও জানা যায়, খুলনা বিভাগে ৫টি অটো রাইস মিল ও ৬০৮টি হাস্কিং মিল চাল দিতে পারেনি। এদের মধ্যে অনেক মিলের পুঁজি নেই, প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। তারা কোনোভাবেই চাল দিতে সক্ষম নয়।
কিন্তু এসব মিল সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এসব মিল মালিককে নির্দিষ্ট সময় দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ১ আগস্ট পর্যন্ত খুলনা বিভাগে ধান সংগ্রহ হয়েছে ৪৮ হাজার ৮০৮ টন, সিদ্ধ চাল ৯২ হাজার ১৯০ টন এবং আতপ চাল ২ হাজার ৬১৭ টন।
খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যারা চাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী যুগান্তরকে বলেন, সরকারের কাছে চাল বিক্রি করতে হলে কেজিপ্রতি ২ টাকা লোকসান হবে।
এছাড়া সরকার বলেছে, চালের কালার সটিং (পলিস) করে দিতে হবে, যা কোনোদিন হাস্কিং মিল মালিকের পক্ষে সম্ভব নয়। মূলত বাজারের দাম বেশি থাকায় লোকসান দিয়ে হাস্কিং মিল মালিকরা সরকারকে চাল দিতে পারেনি।
এরপরও আমরা সরকারের কাছে ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচির সময় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রেখেছি। এটি করা হলেও আরও কিছু সংগ্রহ করতে পারবে।