কুষ্টিয়া শহরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাংচুরের সিসিটিভি ভিডিওতে দেখা গেছে, দুজন ব্যক্তি তাতে জড়িত ছিল।
এই ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ এপর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ বলছে, তাদের দুজন মাদ্রাসার ছাত্র এবং বাকি দুজন একই মাদ্রাসার শিক্ষক।
খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার মহিদ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রাথমিকভাবে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দুজনকে শনাক্ত করা হয়, পরে তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, মাদ্রাসাটি একটি কওমী মাদ্রাসা এবং মহামারির মধ্যেও সেটি চালু ছিল।
এই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং পরিচালনা কমিটির কোন সদস্যের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পলাতক রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে, তদন্তে যার নাম আসবে তার বিরুদ্ধেই মামলা হবে।
“ভাস্কর্য ভাঙচুরের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ হলেই সবার পরিচয় সম্পর্কে জানানো হবে। কিন্তু তদন্তে যার নাম আসবে তার বিরুদ্ধেই মামলা হবে, এটা স্পষ্ট,” তিনি বলেন।
ভিডিও ফুটেজ
এর আগে কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত বিবিসিকে বলেছেন, “ফুটেজ দেখেই তদন্ত হচ্ছে”।
শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন ভাস্কর্যটির কাছেই একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে।
তাতে দেখা যাচ্ছে চারপাশে বাঁশ ও কাঠের পাটাতন দিয়ে ভাস্কর্যটি ঘিরে রাখা।
একটি মই বেয়ে দুজনকে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
এই ঘটনার সময় রাতের বেলায় তবে রাস্তায় আশপাশ থেকে কিছুটা আলো এসে পড়েছে।
যাতে দেখা যাচ্ছে ভাস্কর্যটি বানাতে যে কাঠের পাটাতন তৈরি করা হয়েছে ওই দুজন সেখানে উঠে কোন সময় নষ্ট না করে ভাস্কর্যটির উপরের দিকে কিছু একটা দিয়ে জোরে আঘাত করছেন।
দুজনের পরনে সাদা আলখাল্লা ও পায়জামা। শরীরের ওপরের অংশে কালো ভেস্ট অথবা কোটের মতো কিছু পরে আছেন তারা। মাথায় রয়েছে সাদা টুপি।
শনিবার সকালে নির্মাণাধীন সাদা রঙের ভাস্কর্যটির হাত ও মুখের কিছু অংশ ভাঙ্গা অবস্থায় দেখা যায়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় কুষ্টিয়া পৌরসভার উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ভাস্কর্যটির অনেকাংশ নির্মাণ সম্পন্নও হয়েছিল।
স্থানীয় পুলিশ বলছে শুক্রবার গভীর রাতে এই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
সকালে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিটির বৈঠক চলছিল। এতে বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগ দিয়েছেন।
ওদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ আজ কুষ্টিয়া গেছেন। কমিটির এই বৈঠকে তিনি অংশ নিয়েছেন।
একই সাথে কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মি. হানিফ বিবিসিকে বলেছেন, “দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের খুব দ্রুতই গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।”
একটি প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি বিষয়টি তদন্ত করছে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
জেলা প্রশাসক মোঃ আসলাম হোসেন জানিয়েছেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
ওদিকে শনিবার বিকেলে কুষ্টিয়া শহরে জেলার বিএনপির কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
সেখানে বেশ কয়েকটি চেয়ার টেবিল ভাংচুর করা হয়েছে। এই ঘটনায় কোন মামলা হয়নি এখনো।
তবে জেলা প্রশাসক মোঃ আসলাম হোসেন জানিয়েছেন, যে প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে তারা বিএনপি কার্যালয়ে ভাংচুরসহ সকল বিষয় খতিয়ে দেখবে।
ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেফতার হয়নি।
আজ দুপুরের দিকে একটি প্রেস ব্রিফিং করার কথা রয়েছে যাতে আরও বিস্তারিত তথ্য দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর ঢাকায় একটি মুজিব ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে গত কিছুদিন যাবৎ প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে।
যাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে ইসলামপন্থীদের টানাপোড়েন চলছে।
বরাবরই ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থানে সামনের সারিতে থাকা দল হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল ইসলাম এক বক্তব্যের পর উত্তেজনার শুরু।
হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী ২৭ নভেম্বর এক বক্তব্যের পর সেই উত্তেজনাকে আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
তিনি চট্টগ্রামে একটি ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠানে বলেছেন, “কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য স্থাপন করে, সর্বপ্রথম আমি আমার আব্বার ভাস্কর্যকে ছিঁড়ে, টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেব।”
এরপর থেকে ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে দেশব্যাপী বিক্ষোভ চলছে। গত শুক্রবার ঢাকায় ভাস্কর্যবিরোধী একটি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।
চলমান বিতর্কের মাঝেই দেশের বেশ কিছু ইসলামী চিন্তাবিদদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মানবমূর্তি ও ভাস্কর্য যে কোন উদ্দেশ্যে তৈরি করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।”
তারা বলেছেন, “এমনকি কোন মহৎ ব্যক্তি ও নেতাকে মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপন করে শ্রদ্ধা জানানো শরিয়ত সম্মত নয়।”