ডেস্ক নিউজ
সত্যিকার অর্থে গতিশীল কন্টেইনার বন্দর চট্টগ্রাম। পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত আধুনিক সমুদ্রবন্দর। দক্ষতা সক্ষমতার সব সূচকে অগ্রসরমান। মাত্র ৬টি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং দিয়ে পথচলা শুরু। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে একটি সাধারণ খোলা পণ্যের (বাল্ক কার্গো) জাহাজযোগে সর্বপ্রথম ৬ কন্টেইনার পণ্য খালাস হয়। এভাবে দেশের প্রধান বন্দরের কন্টেইনার যুগে প্রবেশ। ৪৪ বছর আগের কথা। এখন বছরে ৩১ লাখ ইউনিট কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। প্রথমদিকে বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে কন্টেইনারে পণ্য পরিবহন বেড়ে চলে। এরপর ১২ থেকে ১৭ শতাংশে উন্নীত হয় প্রবৃদ্ধির হার। বর্তমানে ৬ থেকে ৯ শতাংশ। সমগ্র দেশের আমদানি-রফতানির ৯২ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরে সম্পন্ন হয়। কন্টেইনার শিপিংয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী। নিরাপদ ও সুরক্ষিত, ঝক্কি-ঝামেলামুক্ত। বহুমাত্রিক সুবিধায় কন্টেইনার-নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। পেঁয়াজ-রসুন-আদা, ফলমূল থেকে শুরু করে খুচরা যন্ত্রাংশ, মেশিনারিজ ও যান্ত্রিক সরঞ্জাম, বিলাসবহুল গাড়ি, প্রযুক্তি ও সেবাপণ্য ইত্যাদি মিলিয়ে আজকাল কী না আসছে কন্টেইনারে? এর মধ্যদিয়ে প্রধান এই বন্দর পূর্ণাঙ্গ কন্টেইনার-পোর্টে রূপ নিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের আরও দক্ষতা, সক্ষমতা ও গতিশীলতার জন্য সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, পর্যাপ্ত সংখ্যক নতুন ইকুইপমেন্ট (ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম) আসছে। কন্টেইনার অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নির্মাণাধীন পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) দ্রæত চালুর উদ্যোগ এগিয়ে চলেছে। বন্দর সুবিধা সম্প্রসারণে বে-টার্মিনাল প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে ১৮ নভেম্বর বৈঠক হবে। এতে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা থাকবেন। তিনি আরও জানান, দক্ষতা সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দর বৈশি^ক অবস্থানে আরও ছয় ধাপ উন্নীত হয়েছে। আমরা বন্দর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হন। তাছাড়া কাস্টম হাউসের সাথে আগের চেয়ে সমন্বয় এখন জোরালো হয়েছে। যে কোনো সমস্যার দ্রæত সমাধান হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরের কোলে পাহাড়ি খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর মোহনাব্যাপী চ্যানেলে হাজার বছরের নিরাপদ পোতাশ্রয় চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক বন্দর। প্রকৃতির অপার দান। এই বন্দরের থিম-স্লোগান ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর’। ‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস’। এর জাতীয় গুরুত্ব দেশের অর্থনীতির হৃৎপিন্ড, লাইফ লাইন এবং চালিকাশক্তি হিসেবে। যেকোনো দেশ আপন পরিচিতি খ্যাতি দুনিয়াময় সগৌরবে মেলে ধরতে পারে নিজের বন্দর-সম্পদকে দিয়ে। বহুমুখী কর্মকান্ড, পরিধি, ভ‚মিকার মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দেশ ও জাতির অগ্রগতির সূচক বহন করছে। বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য মানে কালক্রমে বদলে যাওয়া এদেশেরই সার্থক প্রতিচ্ছবি। সাম্প্রতিক সময়ের তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন হলো, গত দশ বছরে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি বন্দর কার্যক্রম। কথায় কথায় ধর্মঘট, কর্মবিরতি কিংবা গুটিকয়েক শ্রমিক নেতার ইশারায় ‘গো স্লো’ বা ‘ধীরে চলো’ এখন অতীত। প্রধান সমুদ্রবন্দর সার্বক্ষণিক (২৪/৭) সচল প্রতিষ্ঠান।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ১৩২ বছরে ধাপে ধাপে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষতা, গতিশীলতা ও সক্ষমতার বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। বৈশি^ক সূচকের মাপকাঠিতে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ব্যস্ত একশ’ কন্টেইনার-পোর্টের তালিকায় এক দশকের ব্যবধানে ৩০ ধাপ অতিক্রম করেছে। এরমধ্যে গেল এক বছরে ছয়টি ধাপ এগিয়ে আজ ৫৮তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। পোর্ট-শিপিং সার্কেলে এ সাফল্য প্রত্যাশিত। বিশ্বে মর্যাদাসম্পন্ন। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরটি জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল ও ব্যাপক অবদান রাখছে। চট্টগ্রাম বন্দরভিত্তিক একক বৃহৎ রাজস্ব প্রতিষ্ঠান কাস্টম হাউসের শুল্ক আয় ছাড়াও ভ্যাট অ্যান্ড এক্সাইজ, কর-রাজস্ব, বন্দরের চার্জ-ডিউজ, বন্দর ব্যবহারকারীদের কর-রাজস্ব খাতে অবদান ইত্যাদি মিলিয়ে বার্ষিক কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব জোগান দিচ্ছে।
করোনা মহামারী সংক্রমণরোধে গত মার্চ মাসের পর দেশের অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লকডাউন শাট ডাউনে বন্ধ থাকে। তবে সমুদ্রবক্ষে বাতিঘরের মতোই নিরবধি জেগে আছে চট্টগ্রাম বন্দর। শুধু তাই নয়; করোনায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সঙ্কটকালে দেশের রফতানিমুখী খাতগুলোসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থানসহ জাতীয় অর্থনীতিকে রাখছে বেগবান ও সাবলীল। বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা খাতে কয়েকশ’ কোটি টাকা বন্দরচার্জ অব্যাহতি দিয়েছে প্রণোদনা হিসাবে।
নিরবচ্ছিন্ন মুনাফা অর্জনকারী দেশের অন্যতম বৃহত্তম বহুপাক্ষিক ও বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর। এর যাবতীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আনুষঙ্গিক ব্যয় সংস্থান করা হচ্ছে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে। এমনকি জাপানের সহযোগিতায় নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী বহুমুখী গভীর সমুদ্রবন্দর মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকার মধ্যে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের কারিগরি সহায়তা, তদারক ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের আর্থিক ও কারিগরি সাহায্যে নির্মিত হয়েছে দেশের চতুর্থ বন্দর পায়রা। ইতোমধ্যে পোর্ট লিমিট কুতুবদিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। চলমান মেগাপ্রকল্প কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে উভয় তীরে বন্দর সুবিধা সম্প্রসারণের সোনালী সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
দক্ষতা, সক্ষমতা ও গতিশীলতা আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্যোগ প্রসঙ্গে গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম ইনকিলাবকে জানান, আমরা প্রধানত তিনটি পদক্ষেপ নিয়ে এগুচ্ছি। প্রায় ৯শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ১০৪টি ইকুইপমেন্ট ক্রয় করা হবে। এরমধ্যে ৪টি কী গ্যানট্রি ক্রেন, শত টনী ভারী মোবাইল ক্রেন, ১১টি আরটিজিসহ ১৮টি যান্ত্রিক সরঞ্জাম আসছে জুনের মধ্যে সংগ্রহের জন্য দরপত্র দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত বন্দরের ইয়ার্ডের এরিয়া বাড়ানো হচ্ছে। বাড়বে অবকাঠামো সুবিধাদি। তৃতীয়ত বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের জনবলের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া জোরদার হচ্ছে। ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা-সক্ষমতা এতে বেড়ে যাবে। বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারী তথা স্টেক হোল্ডারদের সমন্বয় প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বন্দর ব্যবহারকারীদের ভ‚মিকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সচেষ্ট। স্টেক হোল্ডারগণ বিশেষ করে শিপিং এজেন্ট, সিএন্ডএফ এজেন্ট, বার্থ অপারেটর, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, টার্মিনাল অপারেটর, চেম্বার, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বেসরকারি আইসিডি (অফডক) উদ্যোক্তাদের সাথে প্রতিনিয়তই আমাদের সমন্বয় ও বৈঠক হয়। তাদের সুবিধা-অসুবিধা জানান। আমরা সুরাহার উদ্যোগ নিয়ে থাকি।
পোর্ট-শিপিং-বিষয়ক প্রাচীনতম বিশ^খ্যাত জার্নাল লয়েড’স লিস্ট জরিপে পৃথিবীর একশ’ সর্বাপেক্ষা কর্মচঞ্চল কন্টেইনার বন্দরের ২০২০ সালের প্রকাশিত সংস্করণে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের নতুন অবস্থান ৫৮। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি, সক্ষমতা ও পারদর্শিতার মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৮ সালের অবস্থান থেকে ৬ ধাপ উন্নীত হয়েছে। গেল ৩০ আগস্ট প্রকাশিত লয়েড’স লিস্ট জরিপে চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৯ সালে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউএস (২০ ফুট হিসাবে একক ইউনিট) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ টিইইউএস। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দরে দেশের মোট কন্টেইনারের ৯৮ শতাংশ হ্যান্ডেল হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী পরিবহনের ২৭ শতাংশ হ্যান্ডেল হয় কন্টেইনারে। বাকি ৭৩ শতাংশ খোলা মালামাল (ব্রেক বাল্ক কার্গো) সাধারণ জাহাজযোগে পরিবাহিত হয়। যেমন- সিমেন্ট ক্লিংকার, ইস্পাত, খাদ্যশস্য, সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প কাঁচামাল, র-সুগার, পাথর, কয়লা, জ্বালানি তেল প্রভৃতি। কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে লয়েড’স তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৭ সালে ছিল ৭০তম অবস্থানে। ২০১৬ সালে ৭১তম, ২০১৫ সালে ৭৬তম, ২০১৪ সালে ছিল ৮৭তম। ২০১৩ সালে ৮৬তম, ২০১২ সালে ৯০তম, ২০১১ সালে ৮৯তম এবং এক দশক আগে ২০১০ সালে ছিল ৮৮তম অবস্থানে।