ডেস্ক নিউজ
আগামীকাল ১ জানুয়ারি দেশে আবার করোনার গণটিকা শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। তৃতীয় দফার এই গণটিকা চলবে পুরো জানুয়ারি। এই গণটিকায় পুরো মাসে ৩ কোটি ৩২ লাখ টিকার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। এত দিন ইউনিয়ন পর্যন্ত টিকা দেওয়া হলেও এবার টিকা পাবে প্রত্যন্ত গ্রাম ও চরাঞ্চলের মানুষও। এ দফায় নির্দিষ্ট টিকাদান কেন্দ্রের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাবেন। এই গণটিকায় ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী সব শ্রেণির মানুষ নিবন্ধন ছাড়াই টিকা নিতে পারবেন।
জানুয়ারির গণটিকায় সারা দেশে ১১ হাজারের বেশি টিম কাজ করবে। একটা টিম আট কেন্দ্রে টিকা দেবে। বুথ হবে ১১ হাজারের বেশি। পাশাপাশি সাধারণ টিকাদান কর্মসূচি ও বুস্টার ডোজ দেওয়া অব্যাহত থাকবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ও করোনা টিকা বিতরণ এবং ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক দেশ রূপান্তরকে এই গণটিকা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান।
এর আগে গত বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে করোনার টিকা দেওয়া হবে বলে জানান। সেদিন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, প্রতি মাসে অন্তত চার কোটি ডোজ করে টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হচ্ছে। এজন্য জানুয়ারি থেকেই দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে টিকা দেওয়া হবে। আগামী মে-জুনের মধ্যেই সরকারের টিকাদান লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে তিনি সেদিন জানুয়ারির গণটিকার বিষয়টি নির্দিষ্ট করে বলেননি এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেননি।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সরকার এ পর্যন্ত দুই দফা গণটিকাদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম গণটিকা দেওয়া হয় গত ৭ আগস্ট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ওই কর্মসূচির আওতায় ছয় দিনে দেশে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিল ৫০ লাখ ৭১ হাজার মানুষ। এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর এ টিকাদান কর্মসূচির দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কর্মসূচি শুরু হয়ে চলে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ঢাকায়। ঢাকার বাইরে চলে আরও তিন দিন ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশেষ গণটিকাদান কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন দেশে ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯২২ ডোজ টিকার প্রয়োগ হয়। বাংলাদেশে এক দিনে করোনাভাইরাসের টিকাদানের এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড।
এবার বাড়ি বাড়ি টিকা : ডা. শামসুল হক বলেন, ‘এর আগে আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত টিকা দিয়েছি। এবার আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকের আরও ভেতরে একেবারে ওয়ার্ড পর্যন্ত চলে যাব। এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়া হবে। গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাব-ব্লকভিত্তিক টিকাকেন্দ্র আছে। যেমন : মোড়ল বাড়িতে, সর্দার বাড়িতে, এ রকম গ্রামাঞ্চলে টিকাদান কেন্দ্র আছে। সেই বাড়িতেই আমরা টিকা নিয়ে বসে পড়ব। আশপাশের যে দু-তিনশ ঘর আছে, তারা কেউ যেন বাদ না যায়।’
নিবন্ধন লাগবে না : আগামীকাল থেকে শুরু হওয়া গণটিকায় টিকা নিতে নিবন্ধন করতে হবে না বলে জানান ডা. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘এই টিকা দিতে কোনো নিবন্ধন লাগবে না। নিবন্ধন থাকলেও চলবে, না থাকলে নিবন্ধন ছাড়াই টিকা দেওয়া হবে। আমরা তাদের নাম-ঠিকানা, বয়স, পেশা সব লিখে নেব। তারপর সুরক্ষা অ্যাপে নিজেরাই নিবন্ধন করব। আর সে যদি তার ভোটার আইডি ফটোকপি করে নিয়ে আসে, সেটার পেছনে লেখে দেব।’
দেওয়া হবে তিন ধরনের টিকা : জানুয়ারির গণটিকায় দেশের মানুষকে তিন ধরনের টিকা দেওয়া হবে বলে জানান ডা. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘এবার সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া হবে। ১৮ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সী সব মানুষ এই গণটিকায় টিকা পাবেন। জানুয়ারি জুড়ে এই গণটিকায় প্রথম ডোজ দেওয়া হবে। পরের মাসে একইভাবে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে।’
ডা. শামসুল হক বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্বোধন হবে না। এরই মধ্যে আমরা গ্রাম পর্যন্ত নির্দেশনা দিয়েছি। স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠে নেমে গেছেন, কাজও শুরু হয়েছে। মাইক্রো প্ল্যান শেষ। এখন ১ জানুয়ারি থেকে টিকা দেওয়া শুরু হবে।’
গ্রামের মানুষ টিকায় পিছিয়ে : গ্রামের মানুষ এখনো করোনার টিকায় পিছিয়ে আছে বলে জানিয়েছেন ডা. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘গ্রামের কারা ও কতসংখ্যক মানুষ টিকা নেয়নি, আমরা সে তথ্য সংগ্রহ করছি এবং সেসব গ্রামে টিকা দেওয়া শুরু করেছি। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুদিন কুড়িগ্রামের চর অঞ্চলে টিকা দেওয়া হয়েছে। এসব চরে নৌকা ছাড়া যাওয়া সম্ভব না। সেখানে এক চরে পাঁচটা ঘর। আবার পাশের চরে ৫টা ঘর। এক চর থেকে আরেক চরে নৌকা করে যেতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১০টি টিম সারা দিন এসব চরে টিকা দিচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ২৫ হাজার মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়া। সেখানে দুদিনে ২৬ হাজারে বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে।’
৮০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আশা : জানুয়ারির গণটিকা সম্পন্ন করা গেলে টিকাদান লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ পার হয়ে যাবে বলে মনে করেন ডা. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘এই গণটিকা হলে সরকার দেশের জনগোষ্ঠীর যে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসবে। আর জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে।’
টিকার আওতায় ৬৯ শতাংশ মানুষ : দেশে জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকা দেবে সরকার। তাদের মধ্যে গত বুধবার পর্যন্ত ৬৯ শতাংশ টিকার আওতায় এসেছে। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছে ৯ কোটি ৩২ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৬ জন মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে পাঁচ ধরনের করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক, ফাইজার ও মডার্না।
গত বুধবার পর্যন্ত দুই ডোজ মিলে টিকা দেওয়া হয়েছে ১৫ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩০৯ ডোজ। এর মধ্যে শিক্ষার্থীসহ প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৯ কোটি ৩২ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৬ জনকে বা মোট লক্ষ্যমাত্রার জনসংখ্যার ৬৯ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ৫ কোটি ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩৮০ ডোজ বা লক্ষ্যমাত্রার জনসংখ্যার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এর বাইরে গত বুধবার পর্যন্ত দেশে বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৪১৫ জনকে। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস-২০২০ অনুসারে দেশের (প্রাক্কলিত) জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সে হিসেবে সরকারকে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে ২৭ কোটি ৫ লাখ ৭৬ হাজার টিকা দিতে হবে।