ডেস্ক নিউজ
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) দ্বিতীয় ঢেউ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। দ্বিতীয় ঢেউয়ে বড় মাত্রায় পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়নি। তবে ওভেন খাত এখনো নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানির বেশ কিছু বাজারে লকডাউন থাকায় অনেক ক্রেতা সময়মতো পণ্যের মূল্য পরিশোধ করছেন না। একই সঙ্গে অনেক ক্রেতা পোশাকের দরও কম দিচ্ছেন। উদ্যোক্তারা বলছেন, সব মিলিয়ে এখনো পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা আসেনি। ভ্যাকসিনেশনের পর ইউরোপসহ কয়েকটি দেশের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চলছে। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তৈরি পোশাকের চাহিদাও বাড়বে। তখন চাঙ্গা হবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে গত বছরের এপ্রিলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময়ে ৩ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি কার্যাদেশ স্থগিত হয়। পরবর্তী সময়ে স্থগিত হওয়া অর্ডারের ৯০ ভাগ ফিরে আসে। কিন্তু ৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার শেষ পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি। এরপর গত কয়েক মাসে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমে যায়। গত বছর কোভিডসহ বিভিন্ন কারণে প্রতি মাসেই কমে পোশাক রপ্তানি। পোশাক শিল্পের এ অভিঘাত মোকাবেলায় সরকার ২ শতাংশ সুদে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা করে। এছাড়া পুরো শিল্প খাতের জন্য আরো প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করে। এ দফায় তৈরি পোশাক শিল্প বেশ সক্ষমতার সঙ্গে করোনা মহামারি মোকাবিলা করে। নভেম্বর মাসেই উৎপাদন ও রপ্তানি অনেকটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন ও রপ্তানি স্বাভাবিক ছিল।
চলতি বছরের মার্চে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। এপ্রিল পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। যদিও এ সময় করোনার কারণে তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়নি। এ সময় বড় ধরনের রপ্তানি কার্যাদেশ স্থগিত বা বাতিল হয়নি। তবে কার্যাদেশ ও পোশাকের দাম কমেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে তৈরি পোশাকের দাম কমেছে ৪ শতাংশের মতো।
জানতে চাইলে বিটিএমএর পরিচালক সাইয়েদ নুরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, পোশাক খাতে ২০১৯ সাল থেকেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম ছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারির প্রভাবে তা অনেক কমে যায়। গত বছরের তুলনায় এ বছর কিছুটা ভালো আছি। তবে এখনো পোশাক খাত নিয়ে কথা বলার মতো সময় আসেনি।
তিনি বলেন, বিশ^বাজার একটার উপরে আরেকটা নির্ভরশীল। চীন গুছিয়ে উঠতে উঠতেই ভারত করোনার নতুন সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে। আমেরিকা কিছুটা গুছিয়ে উঠলেও ইউরোপ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এ পরিস্থিতিতে করোনার প্রভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থানে পোশাক খাত আছে কিনা, তা নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো হয়নি। আরো দুই-তিন মাস পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে তিনি বলেন, গত বছর ৫০ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট নিয়ে আমরা ৩০-৩২ বিলিয়ন রপ্তানি করতে পেরেছি। আমি মনে করি, এটা অনেক ভালো।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত গত ১০ মাসে ২ হাজার ৬০০ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। নিট খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি অর্জিত হলেও ওভেনে ব্যর্থতার (লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ কম) কারণে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সবচেয়ে কম লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এ মাসে ওভেনপণ্যে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ রপ্তানি কমেছে।
জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকার ওপর আমরা বেশি নির্ভরশীল। ভ্যাকসিন কার্যক্রমের কারণে বর্তমানে সেসব দেশের অবস্থা কিছুটা ভালো। ধীরে ধীরে এসব দেশের বাজার খুলছে। অবশ্য আমাদের এখানে এখন আবার ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, যখন বহির্বিশ^ ভালো থাকে, তখন আমরা ভালো থাকি না। সব মিলিয়ে এখনো পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা আসেনি। তবে যেহেতু চাহিদা কম ছিল, তাই আমরা সমঝোতার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। অর্থাৎ আমরা একটা ভালো সময়ের দিকে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, মিয়ানমার ও ভারতে সেকেন্ড ওয়েভের কারণেও অনেক ক্রেতা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন। নিট খাতে আমরা ভালো করছি। ওভেন খাতে এখনো নেগেটিভ পজিশনে আছি। এ খাতে নতুন কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই। করোনা মহামারির প্রভাব কতদিন থাকবে বা আবার বাড়বে কিনা, আমরা কেউ জানি না। এরপরও বলব, সব বাধা কাটিয়ে ধীরে ধীরে আমরা ভালো কিছুর দিকে যাচ্ছি।
‘দি উইকেস্ট লিংক ইন গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন : হাউ দ্য প্যানডেমিক ইজ এফেক্টিং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার’ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্যমতে, করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নানাভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের পোশাক শিল্প খাত। পোশাক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও কর্মীরা আর্থিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। বিশেষ করে নারী কর্মীরা বিভিন্ন ঝুঁকিতে পড়েছেন। বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, করোনার কারণে বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া, শিপমেন্ট দেরি হওয়া, সময়মতো পণ্যের মূল্য না পাওয়াসহ বিবিধ কারণে গার্মেন্টস খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিমারি পরিস্থিতিতে উৎপাদন খরচের কম মূল্যে ক্রয়াদেশ নিতে বাধ্য হয়েছে দেশের ৫৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান।
জানতে চাইলে সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং আমাদের বেশির ভাগ রপ্তানিকারক দেশ করোনা মোকাবেলা করে রিকভারির দিকে যাচ্ছে, সেখানে পোশাকের চাহিদাও বেড়েছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সত্তে্বও আমরা কারখানা খোলা রেখেছি। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলে বিশ্ববাজারে সৃষ্ট নতুন সুযোগ আমরা নিতে পারব। যদিও পোশাকের মূল্য কম পাচ্ছি, কিন্তু পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। এতে কিছুটা ধীরগতি হলেও প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছে। নিটওয়্যারের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্যও সুখবর বয়ে আনছে।