ডেস্ক নিউজ
- অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে উন্নতি
- প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে রয়েছে দেশ
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন চার দশক আগে চালু করেছিল এক সন্তান নীতি; অর্থাৎ এক দম্পতি একটির বেশি সন্তান নিতে পারবেন না। তখন গরিবি হালের চীন জনসংখ্যার চাপ নিতে পারছিল না। কিন্তু অর্থনীতির ভিত শক্ত হওয়ার পর পাঁচ বছর আগে নীতি বদলে এক পরিবারে দুই সন্তান নেয়ার অনুমতি দেয়। ২০২১ সালে এসে চীন এবার তিন সন্তানের অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার অর্থ চীন এখন জনসংখ্যা বাড়াতে চাইছে। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীন তৈরি পোশাক রফতানিতে শীর্ষে। অন্যদিকে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ছোট্ট এই পরিসংখ্যানেই বলছে ১৬ কোটির বেশি মানুষের বসবাস এই দেশটির জনসংখ্যাই যেন সম্পদ। দেশের সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে সরকার। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন সূচকগুলোতেও বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। কিছু সূচকে প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যার বোনাস কালের সুবিধা যদি অর্জন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যেমন বাড়বে, তেমনি অধিকসংখ্যক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকবে এবং তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণও বাড়বে।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল বাঙালী জাতি। অর্জন স্বাধীন একটি ‘দেশ’। এরপর মুক্ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশে বৈষম্যহীন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই দেশের মানুষ যাতে আর কোন দিন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার না হয়, গ্রামপ্রধান-কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সেজন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর। দারিদ্র্য জয় করে দীর্ঘ ৫০ বছরে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। রফতানি, রিজার্ভ, জিডিপি থেকে শুরু করে দেশের বাজেটের আকার, সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, রেমিটেন্স আহরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, বিদ্যুত উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে সফলতা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল যারা তারা আজ এ দেশকে ‘উন্নয়নের মডেল’ মনে করছে। স্বাধীনতার পর এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির এ অর্জনকে ‘রোল মডেল’ মনে করছে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ।
গত পাঁচ দশকে দেশের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সার্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে। যুদ্ধপরবর্তী দেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৬.৩ বিলিয়ন। বর্তমানে সেটি দাঁড়িয়েছে ৩৩০ বিলিয়নের বেশি। ১৯৭৫-এর পর থেকে আজ পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে তার ৭৩ শতাংশ হয়েছে গত ১২ বছরে। তিনি বলেন, অস্বাভাবিক এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় অবদান বঙ্গবন্ধুর। কারণ তিনি শক্তিশালী একটি ভিত্তি দাঁড় করে রেখে গেছেন। তিনি জনসংখ্যা কমানোর জন্য নীতি তৈরি করেছিলেন। কৃষি উন্নয়ন, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, মানবিক উন্নয়ন, এসব এর ভিত্তি তিনিই তৈরি করেছেন। আমাদের রেমিটেন্স বেড়েছে ২৮৫ গুণ। রফতানি আয় ১৩৩ গুণ বেড়েছে। তিনি আরও জানান, গত ১২ বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩ গুণ, রিজার্ভ ৭ গুণ। চাল উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণ। মাছ সবজি ৬ গুণ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। কৃষির বাইরেও গ্রামের মানুষের আয় বেড়েছে ডিজিটাল ব্যবসায়। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের কাজ সম্পন্ন হলে দেশের চেহারা বদলে যাবে উল্লেখ করে সাবেক এ গবর্নর বলেন, অর্থনীতির এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে এবং আরও সামনে এগিয়ে যেতে দেশের মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে।
জানা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। এরপর ২০৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় সরাসরি যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এজন্য বাংলাদেশের সামনে বিরাট সুযোগ হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। মূলত একটি দেশের জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক কাঠামো অনুযায়ী কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৪ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের উর্ধে) ছাড়িয়ে যায় তখন সে দেশে একটি সুযোগের সৃষ্টি হয়, যে সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের উন্নতি সাধন করতে পারে। জনমিতির ভাষায়, এই অবস্থানকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা প্রতিটি দেশ তার জীবদ্দশায় কেবল একবারই পেয়ে থাকে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল-ইউএনএফপিএর সংজ্ঞা অনুযায়ী জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা হলো, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা, যা জনসংখ্যাগত কাঠামোর পরিবর্তন। প্রধানত, কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৪ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের উর্ধে) ছাড়িয়ে যায়।’ সাধারণত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এই ক্ষেত্রটি তৈরি হয় কোন দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাসের ফলে। শিশু মৃত্যুহার অনেকাংশে হ্রাসের ফলে উচ্চ জন্মহার থেকে কোন দেশ যখন নিম্ন জন্মহারে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘদিন এই অবস্থান ধরে রাখে তখন ০-১৪ বছরের নির্ভরশীল জনসংখ্যার ভিত্তিটা অনেকাংশে ছোট হয়। পাশাপাশি দুই দশক বা তার বেশি সময়ের আগেকার জনসংখ্যার অংশটি এ সময় কর্মক্ষম জনসংখ্যার (১৫-৬৪ বছর) মধ্যে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বয়স্ক জনসংখ্যা (৬৫ বছরের উর্ধে) যে পরিমাণে থাকে তা কর্মক্ষম জনসংখ্যার সাপেক্ষে অনেক কম। এভাবে কর্মক্ষম জনসংখ্যার সাপেক্ষে তখন একটি দেশে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বেশ কম হয়ে জনবৈজ্ঞানিক মুনাফার সুযোগ তৈরি করে। যে কোন দেশে এই সুযোগটি দুই বা তিন দশকব্যাপী বহাল থাকে। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে উচ্চ জন্মহার থেকে নিম্ন জন্মহারে প্রবেশ করেছে। ১৯৭৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে জন্মহার ছিল ৬.৩ (প্রতি হাজারে একজন মহিলা তার প্রজননক্ষম বয়সে যত জন বাচ্চা নিতে পারে), যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২.৩-এ । ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশী নারীরা গড়ে ৬.৩টি সন্তান জন্ম দিতেন, ২০১৯ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২.৪টিতে। ১৯৭১ সালে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৪.৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ২.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে মা-মৃত্যুর হার ২০১৯ সালে ০.১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুহার ২১ এ নেমে এসেছে। বাংলাদেশে মা-মৃত্যুর হার ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে ১.৬৫। মানুষের গড় আয়ু পাঁচ দশকের ব্যবধানে ৫০ থেকে বেড়ে ৭২.৬ বছরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মর্টালিটি এ্যান্ড হেলথ কেয়ার সার্ভে (বিএমএমএস), স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) এবং ইউএন (ইউনাইটেড নেশন) ইস্টিমেট সূত্রে জানা গেছে, দেশে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। ৯০-এর দশকে প্রতি এক লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৫৭৪ জন সন্তানসম্ভবা নারীর মৃত্যু হতো। ২০১৯ সালে যা কমে প্রতি লাখে ১৬৫ জনে দাঁড়ায়। সে হিসেবে ৯০-এর দশকের তুলনায় মাতৃমৃত্যু ৭০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারও ধনাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৬২.৪ শতাংশ, যা ১৯৯৩-৯৪ সালে ছিল ৪৪.৬ শতাংশ। একই সঙ্গে শিশু মৃত্যুহার ৮৭ থেকে কমে এসে ২০১৪ সালে ৩৮-এ দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে চারটি সুবিধা পাওয়া যায়: ক. শ্রমের জোগানের উন্নতি, খ. সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি, গ. মানবপুঁজি এবং ঘ. দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ। এ চারটি সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে যদি এ কর্মক্ষম যুবশক্তিকে কাজে লাগানো যায়। এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পিরিয়ড একটি দেশে সর্বোচ্চ ২০-৩০ বছর স্থায়ী হয়। অর্থাৎ ২০৪০ সাল নাগাদ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগিয়ে দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগটি হ্রাস পেতে শুরু করবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬৯ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ হল ৮ কোটি ৩৭ লাখ ৯২ হাজার। নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৬ লাখ ৭৭ হাজার। মোট জনসংখ্যার ৬৬ দশমিক ৬৯ ভাগ অর্থাৎ ১১ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার নারী-পুরুষ কর্মক্ষম। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম, তবে শ্রমশক্তির বাইরে। এর মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারী-পুরুষ রয়েছে। দেশের সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশের এ স্বর্ণালি সময় এসেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে ১ নম্বর অগ্রাধিকার প্রদান করায়। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহারকারী ৬২ দশমিক ৪ ভাগ। নারীপ্রতি গড় সন্তান সংখ্যা বা টিএফআর ২ দশমিক ০৫। মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ১৭২ জন। ২০৩০ সালে এ হার হ্রাস পেয়ে হবে ৭০। গত এক দশকে মাতৃমৃত্যু হ্রাস পেয়েছে ৪০ শতাংশ। নবজাতকের মৃত্যু হার হ্রাস পেয়ে এখন প্রতি হাজার জীবিত জন্মে হয়েছে ২৪। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অপূর্ণ চাহিদা এখন শতকরা ১২ ভাগ। সর্বোপরি মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরের কিছু বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল ৬৭৬ টাকা। সে হিসেবে একজনের দৈনিক আয় ছিল ১ টাকা ৮৫ পয়সা। সেখান থেকে ক্রমাগতভাবে বেড়ে বর্তমানে বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার বা, ১ লাখ ৯১ হাজার ৫২২ টাকা। দৈনিক হিসেবে প্রতিজন বর্তমানে ৫২৫ টাকা আয় করেন, যা আগের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ৯ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে ভারতের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ১৯১ ডলার। আর পাকিস্তানকে অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছে বাংলাদেশ। দেশটির মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪৩ টাকা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলেন, ২০৪০ সালের মধ্যে যদি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যবহার করা না যায়, তবে অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা সংকুচিত হতে থাকবে। কেননা, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পিরিয়ড পার হয়ে গেলে জন্মহার ও মৃত্যুহার আরও কমে যাওয়ার কারণে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে। অর্থাৎ এ কর্মক্ষম যুবগোষ্ঠীই ৩-৪ দশক পর সমাজের তথা দেশের জন্য বোঝা হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ জন্মহার হ্রাস ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির কারণে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকবে, পক্ষান্তরে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, যেহেতু বিশ্বে ফার্টিলিটি রেট অনেকদিন ধরেই কমছে। একজন নারী গড়ে যত শিশু জন্ম দেয় তাকে বলে ফার্টিলিটি রেট বা সন্তান জন্মদানের হার, অর্থাৎ নারীপ্রতি জীবিত জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা। গবেষকদের মতে, যখন কোন দেশে ফার্টিলিটি রেট ২.১-এর নিচে নেমে যায়, তখন সেই দেশের জনসংখ্যা কমতে থাকে।
আছিয়া বেগম চার সন্তানের মা। থাকেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ে, রেললাইন বস্তিতে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। ফলে পাঁচজনের সংসার সামলানোর পুরো ভার এসে পড়ে আছিয়ার ওপর। কিন্তু এতে ক্ষোভ নেই। বস্তির অদূরেই কারওয়ান বাজারে সবজি বিক্রি করে সংসার চালান। আছিয়া বলেন, আমার আরও পোলাপাইন হইলে কী ফালাইতে পারতাম? একই বস্তির রমিজা বেগমের দুটি সন্তান। জানান, ‘বেশি সন্তান নিলে খাওয়ামু কি, পরামু কি?’ এক সন্তানকে স্কুলে দিয়েছেন। আরেকটি আগামী বছর স্কুলে যাবে।
কথা হয় মালেকা বেগমের সঙ্গে। সেও একাধিক সন্তানের মা। মনে করেন, অধিক সন্তান কোন সমস্যা নয়। পোলাপান মানুষ করতে পারলে সম্পদ। এহন সবতো মানুষ হয় না। দুয়েকটা অমানুষও হয়। হাতের পাঁচ আঙ্গুল কী সমান হয়? অবশ্যই এই ধারণার সঙ্গে একমত নন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরিফুর রহমান ফাহাদ। যিনি গত বছরই বিয়ে করেছেন এবং তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। ফাহাদ বলছেন, তারা বাস্তবিক কারণেই এক সন্তানের পক্ষে। মিরপুর ১৩ নম্বরে একটি কিন্ডারগার্টেন চালাতেন দুই সন্তানের জনক আফসার উদ্দিন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে। এখন নিয়মিত মৌসুমি ফল বিক্রি করেন। তিনি বলেন, চার সদস্যের পরিবার নিয়ে করোনার আগে বেশ ভালই ছিলাম। কিন্তু মহামারী করোনা জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস বা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে শিক্ষা। উন্নয়নেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের অবদান অনেক বেশি। অদক্ষ জনগণ একটি দেশের বোঝা। পক্ষান্তরে দক্ষ জনগণ দেশের সম্পদ, যা মানবসম্পদ নামে পরিচিত। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ। মহামারী সত্ত্বেও ২০২০ সালে বাংলাদেশ ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৯৯ জন নাগরিককে কাজের সুবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা নিতে ব্যক্তি, সরকার, উদ্যোক্তা, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর কত লোক প্রবেশ করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান রাখা দরকার। শ্রমবাজারে প্রতিটি লোকের যোগ্যতা কী, দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে কি-না, উন্নত বিশ্বে কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে কি-না- সেগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করা ও সার্বক্ষণিক মূল্যায়ন করা জরুরী। আনুমানিক ২০ লাখ লোক প্রতি বছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। ধারণা করা হয়, ব্যক্তি, সরকার, উদ্যোক্তা, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে মিলে সর্বমোট ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। বাকি ৮-১০ লাখকে আমরা সেবা প্রদানের সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত করতে পারিনি, যা বিশাল অপচয়।