ডেস্ক নিউজ
ঢাকার হাম্মাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম। জাল ‘শিক্ষক নিবন্ধন’ সনদে প্রায় এক যুগ শিক্ষকতা করেন তিনি। মহসিন নামের আরেক ব্যক্তির সনদও জাল করেছিলেন তিনি।
২০০৮ সাল থেকে এ শিক্ষক সরকারি বেতন-ভাতা (এমপিও) গ্রহণ করেন। তার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস থেকে গত বছরের ১৫ নভেম্বর স্কুলে চিঠি দেওয়া হয়।
অন্যদিকে পটুয়াখালীর ধুলিয়া হাইস্কুল ও কলেজের প্রভাষক অজয় কৃষ্ণদাসও জাল সনদে চাকরি নেন। তিনি এমপিওভুক্ত হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকেই গ্রহণ করেন দুই লাখ ৯৫ হাজার ৭৫০ টাকা।
শুধু এ দুজনই নন, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত এক হাজার ৭৮৭ জন শিক্ষকের জাল সনদ চিহ্নিত করা হয়েছে। যাদের কেউ নিবন্ধন সনদ আবার কেউ বিভিন্ন স্তরের একাডেমিক, ডিপ্লোমা ও পেশাগত জাল সনদ তৈরি করে স্কুল-কলেজ এবং মাদরাসায় চাকরি নেন।
এরই মধ্যে এক হাজার ৬৪ জনের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। তাদের এমপিওভুক্তি সুবিধা হিসেবে বেতন-ভাতা বাবদ নেওয়া ৪৬ কোটি টাকার বেশি ফেরত এসেছে সরকারি কোষাগারে।
২০১৩ থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদন্ত চালিয়ে সংস্থাটি জাল সনদ শনাক্ত করে।
ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশে প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও তদন্ত করে কারও কারও চিহ্নিত হচ্ছে ভুয়া সনদ। আবার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে জাল সনদ পাওয়া যাচ্ছে।
তবে জনবল সংকটের কারণে প্রত্যাশিত পর্যায়ে তদন্ত করা যাচ্ছে না বলে জানান ডিআইএ পরিচালক। তিনি বলেন, জাল সনদে চাকরি নেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা সাধারণত সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠান।
বিভাগভিত্তিক ভুয়া সনদ ও অর্থ আদায়
ডিআইএ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে জাল সনদধারী ৩৩৮ জন বেতন-ভাতা বাবদ নিয়েছেন নয় কোটি ২৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬৫ টাকা।
এছাড়া চট্টগ্রাম ও সিলেটে ৪৭ জন নিয়েছেন দুই কোটি ৭২ লাখ ৯ হাজার ৪৭৯ টাকা, রাজশাহীতে ২১ কোটি ৮৬ লাখ ৩৮ হাজার ২৮১ টাকা নিয়েছেন ৪৪৬ জন, খুলনা ও বরিশালে ২৩৩ জন বেতন-ভাতা বাবদ নিয়েছেন ১২ কোটি ৯৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯৭ টাকা।
এছাড়া আরও অন্যান্য মিলিয়ে সারাদেশে এক হাজার ৬৪ জনের জাল সনদ চিহ্নিত হয়েছে। এদের থেকে রাজস্ব খাতে ফেরত দেওয়া হয়েছে মোট ৪৬ কোটি ৭৮ লাখ ৮৩ হাজার ৬২২ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৫ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হচ্ছে। এর আগে শিক্ষক নিয়োগে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেরাই বিজ্ঞপ্তি দিতো। অবশ্য ওইসব নিয়োগ বোর্ডে থাকতেন সরকারি প্রতিনিধিরা।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, একজন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার আগে তার কাগজপত্র স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় যাচাই হওয়ার কথা। এছাড়া এমপিওভুক্ত হওয়ার আগে এসব শিক্ষকের কাগজপত্র যাচাই হওয়ার কথা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি)। এত কিছুর পরও কী করে জাল সনদে নিয়োগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা এমপিওভুক্ত হন।
অভিযোগ রয়েছে, জাল সনদধারীদের ধরার ব্যাপারে অনীহা রয়েছে শিক্ষা প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের। এর মধ্যে এনটিআরসিএ, মাউশি এবং মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র আছে। তারা পরস্পর যোগসাজশে একদিকে ভুয়া সনদধারীদের রক্ষা করছে। আরেকদিকে প্রয়োজনে ভুয়া সনদ পেতেও সহায়তা করছে।
ডিআইএ’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, জালিয়াতদের শনাক্ত করে দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে কেউ কেউ পার পেয়ে যাচ্ছেন।
এমন একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, খুলনার দৌলতপুরে একটি কলেজের হিসাববিজ্ঞানের এক প্রভাষক জাল সনদে চাকরি নেন বলে তাদের তদন্তে ২০১৮ সালে ধরা পড়ে। কিন্তু তাকে পরে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয় মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শাখা। এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও পরে তা চাপা পড়ে যায়।
ডিআইএ’র পরিচালক আজমতগীর জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কর্মকর্তারা যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদন্তে যান, তখন তারা শিক্ষকদের যোগদানের সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করেন। তাদের যাচাইয়ে জাল পেলে সেইভাবে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তি (আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগে) আরেকটি সনদ হাজির করেছেন। পরে তার আলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপিত সনদটি হয়তো আসল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তাই হয়, তাহলে আসল সনদটি এলো কোথা থেকে। আর চাকরি নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী সেটি দাখিল করলেন না কেন। কিংবা এক সনদে চাকরি নিয়ে পরে আরেক সনদ প্রদর্শন করলে চাকরির বৈধতা থাকে কি না। এসব নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।