ডেস্ক নিউজ
দেশের সর্বত্র মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার থাবা। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে কার্যত চলমান লকডাউন নিশ্চিতে যখন উচিত আরও কঠোরতা আরোপ, তখন এসেছে বিপরীত এক সিদ্ধান্ত, খুলে দেওয়া হয়েছে পোশাক কারখানাগুলো। অত্যন্ত ছোঁয়াচে করোনার হাত থেকে রক্ষা পেতে যখন পরস্পরের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব অত্যন্ত জরুরি, তখন এসেছে উল্টো সিদ্ধান্ত যা জনসমাগম বাড়াবে, অবনতি ঘটাবে করোনা পরিস্থিতির।
কেন পোশাক কারখানাগুলো চালু করার সিদ্ধান্ত মালিকদের? জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি সত্ত্বেও কেনইবা এতে সরকারের সায়? হ্যাঁ, কারণ আছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রপ্তানি আয়। এ আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প। কিন্তু এ খাতও করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ যা একটি তথ্যেই অনুমেয়। গত বছরের এপ্রিল মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২৪২ কোটি ডলারের পোশাক।
আর চলতি বছরের এপ্রিলে তা নেমে এসেছে ৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারে। অর্থাৎ রপ্তানি কমে গেছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বরাত দিয়ে বিজিএমইএ দেওয়া এ তথ্য শুধু এ খাতের জন্যই নয়, দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যই এক ভয়াল অশনিসংকেত। এ কারণেই এমন সিদ্ধান্ত। পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, তা মোকাবিলা করেই এ খাতকে বাঁচাতে হবে তথা দেশের অর্থনীতির মেরুদ- সোজা রাখতে হবে। পাশাপাশি সব তরফেই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় কঠোর হওয়ার বিষয়ে, অনেকের সংশয় সত্ত্বেও।
ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হিসেবেই করোনা আগ্রাসী রূপ ধারণ করার পরও গত ২৬ এপ্রিল স্বল্প আকারে পোশাক কারখানাগুলো খুলতে শুরু করে। এরই মধ্যে প্রায় সব কারখানা খুলেছে। বিজিএমইএ বলছে, করোনার কারণে ক্রেতারা অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। পোশাক কারখানাও বন্ধ ছিল মাসখানেক। তৈরি পোশাক রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে এ কারণে। গত মার্চ থেকেই পোশাক রপ্তানিতে ধস নামতে থাকে।
তার পরও ওই মাসে ২২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তবে সেটি গত বছরের মার্চের চেয়ে ২০ শতাংশ কম। পোশাক খাতের জন্য চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের মধ্যে এটিই ছিল ভয়াবহ। তবে শেষ পর্যন্ত মার্চকেও ছাড়িয়ে গেল এপ্রিল। এক মাসের ব্যবধানেই ১৮৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি কমে গেছে।
বিজিএমইএ জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে ৩৩১ কোটি ডলার, আগস্টে ২৪০, সেপ্টেম্বরে ২৩৪, অক্টোবরে ২৫২, নভেম্বরে ২৫১, ডিসেম্বরে ২৯৩, জানুয়ারিতে ৩০৩, ফেব্রুয়ারিতে ২৭৮, মার্চে ২২৫ এবং এপ্রিলে ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তাতে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
বিজিএমইএর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ১ হাজার ১৫০টি কারখানার ৯৮ কোটি পিস পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল হয়েছে। তাতে ৩১৮ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
অবশ্য সুইডেনভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম তাদের মনোনীত কারখানায় ইতোমধ্যে যেসব পোশাক তৈরি হয়েছে, সেসব পোশাক নেওয়ার ঘোষণা দেয়। অনেকটা সেই পথেই হাঁটবে বলে ইঙ্গিত দেয় পিভিএইচ, টার্গেট, গ্যাপ ও ভিএফ করপোরেশন, ইন্ডিটেক্স, টেসকো, কিয়াবি, এলপিপিসহ কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড। তবে কিছু ব্র্যান্ড মূল্যছাড় দাবি করেছে বলে জানান পোশাক রপ্তানিকারকরা।
এ অবস্থার মধ্যে আবার পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় কারখানায় পুরোদমে চলছে কাজ। শ্রমিকরা যথাসম্ভব স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ম মেনে কাজ করছেন। অন্যদিকে কারখানা মালিকরা প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারখানা বন্ধের আগে যেসব অর্ডার ছিল সেগুলো প্রস্তুত করছে। পাশাপাশি এসব পোশাক নেওয়ার জন্য ক্রেতাদের অনুরোধ করা হচ্ছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও ওই সব দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, যাতে তারা অর্ডার অনুযায়ী পোশাকগুলো নিয়ে নেয়।
সামনের পরিবেশের কথা মাথায় রেখে নতুন করে অর্ডার নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য বেশ কয়েকটি দেশ থেকে নতুন করে পোশাক নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন কারখানা মালিকদের সঙ্গে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বড় কারখানাগুলো পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানা চালাচ্ছে। তবে, ছোট-মাঝারি কারখানগুলোর মধ্যে বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে গত ২ মে গার্মেন্ট পরিদর্শনে নির্দেশনা জারি করে অধিদপ্তর। নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানা পরিদর্শনের জন্য অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শকদের সমন্বয়ে ঢাকায় ২৩টি এবং গাজীপুরে ২৭টি টিম গঠন করা হয়েছে। বিশেষ এই পরিদর্শনে শুধুমাত্র কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপ, শ্রম পরিস্থিতি দেখা হবে।
সূত্র জানায়, পরিদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অনিয়ম পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে কারখানা কর্তৃপক্ষকে সতর্কীকরণ চিঠি দেওয়া হবে। তারপরও ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অনিয়ম সংশোধন না হলে শ্রম আইন ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে বিজিএমইএকে চিঠি দিয়ে ওই কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হবে।
অন্যদিকে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ কারখানা চালুর বিষয়ে একটি গাইডলাইন করেছে। এ গাইডলাইন অনুযায়ী কারখানা চালানো হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে বিজিএমইএর মনিটরিং টিম কাজ করছে। কোন কোন কারখানায় বিজিএমইএর গাইডলাইন বা নির্দেশিকা অনুযায়ী নিরাপত্তা শর্ত প্রতিপালন হচ্ছে না- শ্রমিক নেতাদের এ অভিযোগের কারণে মনিটরিং টিম আকস্মিক কারখানা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। এসব টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিজিএমইএর পরিচালকরা। কোনো কারখানায় গাইডলাইনের ব্যতিক্রম দেখা গেলে ওই কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে পরিদর্শন টিমের দায়িত্বে থাকা বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল আমাদের সময়কে বলেন, যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করব। যদি কোনো কারখানা মালিক আইন লঙ্ঘন করেন তা হলে তার বিরুদ্ধে বিজিএমইএ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, দু-একজনের জন্য পুরো পোশাক খাত দায় নেবে না।
নতুন অর্ডারের বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর পরিচালক ফজলে শামীম এহসান আমাদের সময়কে বলেন, বেশ কিছু ক্রেতা নতুন অর্ডারের জন্য যোগাযোগ করেছে। আমরাও চেষ্টায় আছি। তবে বর্তমানে সার্জিক্যাল মাস্কের চাহিদা পুরো বিশ্বজোড়া। অনেকেই মাস্ক নিতে চায়, কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে ধরে রাখতে পারছি না।
এদিকে বিজিএমইএর পরিচালক মোহাম্মদ নাসির বলেন, ক্রেতারা যেসব অর্ডার বাতিল করেছিল, সেগুলো নেওয়ার জন্য তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী কেউ কাপড় কেটেছে, কেউ সেলাই করেছে, আবার কেউ প্যাকেটজাত করে শিপমেন্টের অপেক্ষায় ছিল। আবার কেউ শিপমেন্ট করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের তো কোনো অপরাধ নেই। আশা করা যায় তারা তাদের দেওয়া অর্ডার অনুযায়ী পোশাক নিবেন।
বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক আমাদের সময়কে বলেন, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে করোনায় কারখানা খোলার বিকল্প কোনো পথ নেই। লাগাতর কারখানা বন্ধ থাকলে শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, কিছু আশার দিকও আছে। টিকে থাকতে পারলে বাংলাদেশের জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি হবে। আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যাতে করে তারা আমাদের ছেড়ে না যায়।