ডেস্ক নিউজ
গত বছর করোনা মহামারী শুরু হলে জাপান, চীনসহ বেশকিছু দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার হতে শুরু করে। এসব বিনিয়োগ টানতে চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের শেষ ভাগে চীন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা জাপানী দুটি কারখানার গন্তব্যস্থল হয় বাংলাদেশ। কিন্তু বেশিরভাগ বিনিয়োগ চলে যায় ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো ও ভারতে। এই বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যতম লাভজনক বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে বড় পরিসরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করেছে সরকার। রাজধানীর রেডিসন হোটেলে ২৮ ও ২৯ নবেম্বর দুদিনব্যাপী হবে এই সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। এতে দেশের অন্তত এক হাজার বিনিয়োগকারী ও ১৫ দেশ অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় বিদেশী বিনিয়োগ আনা এ সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৮৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বাংলাদেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই তিন মাসে ৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি, প্রায় ৫০ শতাংশ। এই তিন মাসে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪ কোটি ডলার। গত বছরের এই তিন মাসে নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। মহামারী করোনার মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৬৮ লাখ ৬০ হাজার ডলারের (৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) এফডিআই এসেছিল বাংলাদেশে। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি ৭৩ লাখ (২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন) ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। তার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশী বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা। বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়। জাপানের বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমুরা হোল্ডিংসের এক জরিপে দেখা যায়, চীনে নিবন্ধিত ৬৯০টি জাপানী কোম্পানির মধ্যে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত ৭৯টি কোম্পানি চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি ভিয়েতনামে, ১১টি তাইওয়ানে, ৮টি থাইল্যান্ডে, ৬টি মেক্সিকোতে ও ৩টি ভারতে গেছে। বাংলাদেশ পেয়েছে দুটি।
জানা গেছে, নতুন ভিত্তি বছর (২০১৫-১৬) অনুযায়ী, চলতি মূল্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার (জিডিপি) এখন ৪১১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩৫ লাখ ২৬ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। সে হিসেবে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির বাংলাদেশ হলে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ হবে প্রায় ৪৩ লাখ কোটি টাকা। তবে বর্তমানে বিদেশী বিনিয়োগে বেশ কিছু বাধা রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশী বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশী বিনিয়োগও বাড়বে না। ‘গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে, জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার কারণে তা আরও কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘করোনায় বিশ্ব বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় পুঁজির চলাচল একেবারে স্থবির ছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে। এর মধ্যেও যে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে এফডিআইয়ে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এটাকে আমি ভালই বলব।’ প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী খাত ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সম্প্রতি ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য আমরা অনেক ইনসেনটিভ দিয়েছি। বিডা একগুচ্ছ সুযোগ সুবিধা দিয়েছে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে। বন্দর, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুতসহ ইউটিলিটির ব্যাপক উন্নতি করা হয়েছে। এই বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যতম লাভজনক বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে বড় পরিসরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করা হচ্ছে।
বিডা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আয়োজনে এই সম্মেলনের সহযোগী হিসেবে থাকছে আইএফসি। এর আগে বাংলাদেশে সর্বশেষ বিনিয়োগ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তখনকার বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের অধীনে। ওই বছরই বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারীকরণ কমিশনকে একীভূত করে গঠিত হয় বিডা। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ার পর এই প্রথম দেশের মাটিতে এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে। ২০২০ সালে এ সামিট হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে তা পিছিয়ে যায়। এবারের আয়োজনের প্রতিপাদ্য, ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, যেখানে রয়েছে অসীম বিনিয়োগের সম্ভাবনা’। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলফনসো গার্সিয়া মোরা এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরেমি জারগেনস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন।
সম্মেলনের সার্বিক বিষয় নিয়ে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ টানতে যেসব সংস্কার কার্যক্রম নেয়া হয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে সেগুলো তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ এবং উদ্যোক্তারা কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান, সেটি তুলে ধরা হবে সম্মেলনে।’ এ ছাড়া, করোনা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বিশ্বকে জানান দেয়া হবে বলে জানান তিনি। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমদানি-রফতানি বাড়ছে। অন্য সূচকগুলোও ভাল। রাজনীতিতে অস্থিরতা নেই দীর্ঘদিন। সব মিলিয়ে দেশী বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগেও একটি ভাল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এখন এটাকেই আমরা ভালভাবে কাজে লাগাতে চাই। দেশে আরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আনতে চাই।’ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজও শেষ হয়ে গেছে। আরও কয়েকটির কাজ শেষের দিকে। ২০২৩ সাল থেকে ভিন্ন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছে। ‘আশা করছি, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে।’
সম্মেলনে কয়েকটি প্ল্যানারি সেশনের পাশাপাশি খাতভিত্তিক কারিগরি অধিবেশন হবে। সেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতা এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, তথ্যপ্রযুক্তি, তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিকস এ্যান্ড ইলেকট্রিক শিল্প, কৃষি, চামড়া, ওষুধশিল্প, স্বাস্থ্য, পুঁজিবাজার, পরিবহনসহ ১৪টি খাত নিয়ে আলোচনা হবে। প্রতিটি সেশনে একজন বিশেষজ্ঞ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। এর ওপর দেশী-বিদেশী প্রতিনিধিরা আলোচনা করবেন। সংশ্লিষ্ট খাতের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপদেষ্টারা বক্তব্য রাখবেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন, নেদারল্যান্ডস, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ভারত, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের সরকারী প্রতিনিধি ও বিনিয়োগকারীরা অংশ নেবেন এই সম্মেলনে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকসহ (এআইআইবি) বৈশ্বিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।
আয়োজকরা জানান, স্থানীয় নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারী খাতের প্রতিনিধিরাও এতে যোগ দেবেন। ২৮ নবেম্বর রবিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামও বক্তব্য রাখবেন। সম্মেলনের প্রথম দিনে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাতসহ বিনিয়োগের পরিবেশ ও বিনিয়োগ সক্ষমতার সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চলমান পরিকল্পনা। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরা হবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে। এ ছাড়া বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হবে প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিনে পোশাক, বস্ত্রসহ চামড়া ও চামড়াজাত খাতের পণ্য উৎপাদন এবং রফতানি নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) সম্ভাবনা, পুঁজিবাজার, পরিবহন, ওষুধশিল্প, কৃষি ব্যবসায় এবং ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরা হবে।