ডেস্ক নিউজ
দেশে নানামুখী তর্কবিতর্ক ও সংকটের মধ্যেও দিনে দিনে টিকার প্রতি আস্থা বাড়ছে বেশির ভাগ মানুষের। বিশ্বের বহু দেশ যখন করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ কয়েকটি দেশ থেকে টিকার কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে যাওয়ার খবর আসে। এতে টিকার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় ঘটছে না। যাঁরা প্রথম দিকে নিরুৎসাহ ছিলেন, টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন তাঁরা ভিড় করছেন বিভিন্ন টিকাকেন্দ্রে।
সেই সঙ্গে যাঁরা টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর অনেকটা সংশয়ে ছিলেন, তাঁরাও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে টিকার সুফল দেখে ছুটছেন দ্বিতীয় ডোজ টিকার জন্য। তবে এর মধ্যেই আর দুই সপ্তাহ পর দেশে টিকা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা কবে নাগাদ বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নিয়ে উদ্বেগে সরকার। হাতে থাকা টিকা দিয়ে আর বড়জোর ১০ থেকে ১২ দিন টিকা কার্যক্রম চালানো যাবে। ভারত থেকে চুক্তিমতো কিংবা কোভ্যাক্স থেকে প্রতিশ্রুত টিকা সময়মতো আসছে না। তবে চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সংকট কিছুটা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে থেকে।
করোনার টিকার সাফল্যের উদাহরণ তুলে ধরে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেল্প সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গোলাম রাহাত খান গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে যেখানে কয়েক সপ্তাহ আগেও দিনে প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তেমনটা এখন আর নেই। শনাক্ত অনেকটা আশ্চর্যজনকভাবে কমে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যখন তিন কোটি মানুষ প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৬৮ জনকে হাসপাতলে যেতে হয়েছিল। আর দ্বিতীয় ডোজ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের কাউকেই হাসপাতালে যেতে হয়নি। আর যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কারো মৃত্যু ঘটেনি।’
একই সঙ্গে গোলাম রাহাত বলেন, ‘এটি নিশ্চিত করেই বলতে পারছি যে দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর অবশ্যই মৃত্যু থাকবে না, তবে কিছু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং এটি হতেই থাকবে, যা আগেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ টিকা নেওয়ার পর কেউ আক্রান্ত হলেও তাঁদের অবস্থা জটিল হবে না। কিন্তু টিকা নেওয়ার পরও যাতে নিজেরা কেউ আক্রান্ত না হন সে জন্য সবাইকেই নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করে বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি আমেরিকার ওই গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সেখানে টিকা নেওয়ার আগে এবং টিকা নেওয়ার পর ৭০ হাজার মৃত্যু কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর সেই ভয়ানক মৃত্যুপুরী নেই, বরং টিকার সুবাদে দিনে দিনে সংক্রমণ ও মৃত্যু একেবারেই নিচের দিকে নেমে আসছে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বাংলাদেশেও যদি আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষকে টিকা দিয়ে ফেলতে পারি, তবে এখানেও মৃত্যু ও আক্রান্ত কমে যাবে। কিন্তু তার পরও যাঁরা টিকা নিয়েছেন সবাইকে মনে রাখতে হবে যে এই টিকা মৃত্যু থেকে সুরক্ষা দিলেও সংক্রমণ থেকে এখনো পুরোপুরি সুরক্ষা দেবে না। ফলে সবাইকে মাস্ক ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। তা না হলে বারবার বিপদের মুখে পড়তে হবে।’
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত যাঁরা করোনাভাইরাসের টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কারো করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। এখন যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা দ্বিতীয় ডোজ শুরুর আগেই আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে তাঁরা দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি। এমনকি যাঁরা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকে জটিল অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে গেছেন। আমরা টিকা নেওয়ার পর এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনো কাজ করে যাচ্ছি।’
এদিকে বিশ্বের ২২১টি দেশে কমবেশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ থাকলেও এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিকা পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে এখনো ১০ নম্বরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার সাড়ে তিন শতাংশের বেশি মানুষ এ পর্যন্ত টিকা পেয়েছেন, যদিও অনেকের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া বাকি রয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার পরিচালক ডা. মিজানুর রহমানের তথ্য অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত দেশে টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২১ লাখ ৫৫ হাজার ২৯৬ জন। প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৭ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮০ জন। আর টিকা নেওয়ার জন্য গতকাল পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৭২ লাখ ছয় হাজার ৫৬৫ জন। অর্থাৎ এ পর্যন্ত সরকারের হাতে আসা এক কোটি তিন লাখ ডোজ টিকার মধ্যে দেওয়া হয়েছে ৭৯ লাখ ৫৪ হাজার ১৭৬ ডোজ। হাতে আছে আর মাত্র ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৮২৪ ডোজ।
গতকালও প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে টিকা দেওয়া হয়েছে দুই লাখের বেশি মানুষকে। সে হিসাবে হাতে থাকা টিকা দিয়ে বড়জোর ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত চলতে পারে। এরপর টিকা কোথা থেকে আসবে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে সরকার ও জনগণকে।