ডেস্ক নিউজ
‘আমাদের কোনো মান নাই, মযার্দা নাই। গিরাম করে খাই। সাপ খেলা দেখাই। শিঙা দেই, লতাপাতা বেচি। মেয়েছেলেদের গিরাম করতে অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয়। পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ছোট ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকি। জীবনের কোনো নিরাপত্তা নাই। এই যাযাবর জীবন থেকে মুক্তি পাচ্ছি। জীবনে ভাবি নাই, নিজের নামে জায়গা হবে। নিজের ঘর হচ্ছে পাকা। বাচ্চারা পড়বে। বাঁওড়ের ধারের জায়গাটা খুব সুন্দর’ প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাওয়ায় এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের বারবাজার ইউনিয়নের বাদেডিহি গ্রামের বেদেপল্লীর কোহিনুর বেগম।
সরেজমিন গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার বাদেডিহি বেদেপল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার বাসিন্দাদের কথায় এখন আনন্দের সুর। কোহিনুর বেগম বলেন, ‘আলো নেই, চালা নেই, সন্তানদের কোনো জীবন নেই। শেখ হাসিনার উপহারের ঘর আমাদের আসল জীবন দিয়েছে। ৫০ বছর বয়স হইচে, ভাবি নাই এই লাথি-উষ্ঠা থেকে রক্ষা পাব। আল্লাহ তারে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুক।’
দেশের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্যতম হচ্ছে বেদে সম্প্রদায়। তাদের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতেই ভূমিহীন এসব পরিবারকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া হচ্ছে জমিসহ আধাপাকা বাড়ি। কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের মাইছদি বাঁওড়ের পাশেই চলছে বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। কালীগঞ্জের ৫৯ পরিবারকে বিনামূল্যে দেওয়া হবে এই উপহারের বাড়ি। বেদেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে জলাধারের পাশেই নির্মাণ করা হচ্ছে এই ঘর। আগামী জুনের মধ্যেই এ বাড়িগুলো হস্তান্তরযোগ্য হবে বলে মনে করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
বেদেরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় কারও বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা মাঠে-ঘাটে পলিথিনের তাঁবু গেড়ে বসবাস করে আসছে। সাপ খেলা দেখিয়ে বা নদীতে মাছ ধরে যা আয় হয়, তা দিয়েই কোনোরকমে চলে তাদের সংসার। শিক্ষার দিক দিয়েও পিছিয়ে তারা। বংশ পরম্পরায় এভাবে চলে আসা বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কোনো সরকার কখনোই ভাবেনি। পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে নিয়ে আসতে এই প্রথম উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরই অংশ হিসেবে তাদের জন্য ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরেজমিন গতকাল কালীগঞ্জ উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের মাজদিয়া বাঁওড় এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সর্ববৃহৎ এ আবাসনের নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। এ বছরের জুনে ৫৯টি বেদে পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহারের এ ঘর। ঘর পাওয়ার আগাম খবরে খুশিতে আত্মহারা বেদে পরিবারগুলো। নতুন ঘরে কীভাবে থাকবেন, কীভাবে ঘর সাজাবেন সেই স্বপ্ন বুনছেন তারা।
কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, উপজেলার পৌর এলাকার কাশিপুর গ্রামের ২৮টি ও বারবাজার ইউনিয়নের বাদেডিহি গ্রামে ৩১টিসহ ৫৯টি বেদে পরিবার রয়েছে। এ পরিবারগুলোর জমি ও ঘর কোনোটাই না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। তাই আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সারা দেশের গৃহহীন ও আশ্রয়হীন পরিবারের জন্য নির্মিত ঘরের মতো কালীগঞ্জেও দুই একর খাসজমিতে বেদে সম্প্রদায়ের জন্য ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ও গতকাল বারবাজার ইউনিয়নের বাদেডিহি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের কঞ্চি আর পলিথিন দিয়ে তৈরি তাঁবুতে বসবাস করছে ৩১টি বেদে পরিবার। নেই টয়লেট, গোসলখানা। তাঁবুর ঘরগুলো এতটাই ছোট যে, হাঁটু গেড়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। এর ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। ছোট্ট তাঁবুর ভেতরেই রান্না, ভেতরেই খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানে এমনও পরিবার রয়েছে, স্বামীকে নিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে ছোট্ট এই খুপরি ঘরে বসবাস করে আসছে পরিবারের বিবাহিত মেয়ে। বিবাহিত ছেলেও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ছোট্ট তাঁবুতে বাবা-মার সঙ্গে থাকছে, ঘুমাচ্ছে। দিনের বেলায় পরিবারের নারী সদস্যরা গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শিঙা দেন, দাঁতের পোকা বের করেন। চাল, ডালের বিনিময়েই এ কাজ করেন তারা। এতে দৈনিক তিন-চার কেজি চাল পান। আবার কেউ কেউ বাইদ্যার কাজ করছেন। গ্রামের পুকুরে হারিয়ে যাওয়া নাকফুল, নারীদের গহনা উদ্ধার করেন কেউ কেউ। বেদে কন্যারাও বংশ পরম্পরায় এসব কাজ আয়ত্ত করতে মায়ের সঙ্গে যায়। আর সন্ধ্যা নামলেই পুরুষ বেদেদের কেউ বাজারে সাপ খেলা দেখিয়ে, কেউ বানর খেলা দেখিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে সংসার। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে হিমশিম খেতে হয়। অর্থের অভাবে সন্তানদের পড়ালেখা পর্যন্ত করাতে পারছেন না তারা।
বেদেপল্লীর বাসিন্দা রঙ্গিলা বেগম স্বামী আলমগীর, দুই ছেলে আকাশ ও রবিউলকে নিয়ে থাকেন ছোট্ট একটি খুপরি ঘরে। ৫-৬ বর্গফুটের একই ঘরে থাকেন রঙ্গিলা বেগমের ছোট দুই ভাই ও তার মা। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ছোট দুই ভাই ও মা তার সঙ্গেই থাকছেন। স্বামীর আয়েই চলছে এ সাতজনের সংসার।
রঙ্গিলা বেগম জানান, তিনি গ্রাম করেন (শিঙা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা)। এতে কেউ টাকা দেন, কেউ চাল কিংবা ডালও দেন। দৈনিক তিন-চার কেজি চাল পান। তার স্বামী আলমগীর সাপ ও বানর খেলা দেখিয়ে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করেন। স্বামী-স্ত্রীর এ আয়েই চলে ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ, মায়ের ওষুধের ব্যয়সহ যাবতীয় খরচ। কত বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন এমন প্রশ্নে রঙ্গিলা বলেন, ‘আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। বাবা-মাও এখানেই ছিলেন, এখনো আছেন।’
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে উচ্ছ্বসিত রঙ্গিলা বেগম বলেন, ‘কয় মাস আগে স্যাররা আইসা নাম নিয়া গেছেন। হেরা বলছে, হামাগো রে নাকি ঘর দিবোইন। হে ঘরের কাজ চলছ। হামারা অপেক্ষায় আছি।’ ঘর পাওয়ার আগাম খবরে খুশি রঙ্গিলার বৃদ্ধ মা, ছোট ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা। সে ঘরে কীভাবে থাকবেন, কীভাবে সাজাবেন মনের কোণে সেই স্বপ্ন বুনে রেখেছেন রঙ্গিলা বেগম।
বেদেপল্লীর বাসিন্দাদের মধ্যে অনেক পরিবারের মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু সামাজিক কোনো অবস্থান না থাকায়, আর্থিক দিক দিয়ে অসচ্ছল হওয়ায় মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছে না তারা। অর্থাভাবে ছেলেমেয়েকে পড়ালেখাও করাতে পারছে না।
ঘরের কথা বলতেই কোহিনুর হাসতে থাকেন। স্বামী আওলাদ ও এক ছেলে রাহুলকে নিয়ে থাকেন এখানে। আওলাদ সাপ ধরেন, সাপ ও বানর খেলা দেখান। আর কোহিনুর গ্রামে গিয়ে শিঙা দেন ও দাঁতের পোকা তোলেন। খুশিতে আটখানা কোহিনুর বলেন, ‘কোনো আমলে কোনো সরকার আমাগো কথা ভাবেনি। আমরা যে কী কষ্টে দিন কাটাচ্ছি, এক আল্লাহ আর আমরা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এই যে গরমের দিন, মাথার ওপরে একটা ফ্যান পর্যন্ত নাই। আমাগো নামধাম নিয়া গেছে। শুনছি, প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিবেন। যা আয় হয়, তাতেই সংসার চলে না। ঘর করার স্বপ্নও দেখিনি কখনো। ঘর পাইলে অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে।’
বাদেডিহি গ্রামের এই বেদেপল্লীর ৩১টি পরিবারের জীবন কাহিনী একই। একটু দূরেই পৌর এলাকায় বসবাসরত ২৮টি পরিবারেরও একই দৈন্যদশা। যেখানে মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, যেখানে বিলাসিতা তাদের কাছে পাহাড়সমান স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন তারা কখনো দেখেনও না, করেনও না। দুই মুঠো খেয়েপড়ে বেঁচে থাকলেই অনেক। তার ওপর স্বপ্নের আবাসস্থল পাওয়ার খবরে আকাশসমান খুশি তারা।
বেদে সম্প্রদায়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প : বারবাজার ইউনিয়নেরই ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জগন্নাথপুর গ্রামের ‘মাজদিয়া বাঁওড়’ এলাকায় বেদেপল্লীর বাসিন্দাদের জন্য ৫৯টি ঘরের নির্মাণকাজ চলছে। যেখানে কাজ চলছে এর সামনেই পাকা রাস্তা, পাশে হাওর। আশপাশে রয়েছে ফসলি জমি, গাছগাছালি। ইট-বালু, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী সেখানে জমা করা হয়েছে। রাজমিস্ত্রিরা পাইলিংয়ে কাজ করছেন।
ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম বলেন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় বসবাসকারী বেদে সম্প্রদায়ের জন্য মাজদিয়া বাঁওড় এলাকায় ৫৯টি ঘরের নির্মাণকাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন, আশ্রয়হীন ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য যে ঘর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন, তারই অংশ হিসেবে এখানে ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। বেদেরা যেহেতু নদীতে থেকে অভ্যস্ত, তাই হাওরের পাশেই ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে তারা মনে করবেন, তারা নদীতেই বসবাস করছেন। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের নির্মিত ঘরগুলো অধিকতর টেকসই ও দুর্যোগ সহনীয় করে নির্মাণ করা হবে। এখানে বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা থাকবেন বলে রাজি হয়েছেন। এই প্রথম বেদে সম্প্রদায়ের জন্য সর্ববৃহৎ আবাসস্থল করা হচ্ছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ হবে।
তিনি আরও বলেন, ঘরের পাশে খালি জায়গা থাকবে। এতে চাইলে বেদে পরিবারগুলো গবাদিপশু পালন ও শাকসবজি চাষ করতে পারবে। শিশুদের খেলাধুলার জন্য করা হবে পার্ক।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, এ জমিটিও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে ছিল। গৃহহীন, আশ্রয়হীন ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দেওয়া ঘর নির্মাণ করতে যখন জায়গা খোঁজা হচ্ছিল, তখন কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন দুই একরের এ জায়গাটি খাস হিসেবে দেখতে পায়। পরবর্তী সময়ে দখলে থাকা প্রভাবশালীদের কাছ থেকে এ জমিটি উদ্ধার করে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে তৃতীয় পর্যায়ের ঘর নির্মাণকাজ শুরু করে প্রশাসন।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া জেরিন বলেন, মাজদিয়া বাঁওড় এলাকার ৪০ লাখ টাকা মূল্যের এ জমিটি প্রভাবশালীদের দখলে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নপূরণে ও পিছিয়ে পড়া বেদে সম্প্রদায়ের পুনর্বাসনের জন্য এ জমিটি বাছাই করা হয়। পরে প্রভাবশালীদের বুঝিয়ে এখানে ৫৯টি ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। এতে করে বেদে সম্প্রদায়ের ৫৯টি পরিবারের কষ্ট কিছুটা হলেও লাগব হবে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উন্নত জীবন পাবে।
বারবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ জানান, যুগ যুগ ধরে কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেদে সম্প্রদায় বসবাস করে আসছে। সরকারি বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী, শিশুদের শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়। কে বেদে আর কে বেদে নয়, তিনি এসব দেখেন না। তার ইউনিয়নে বসবাস করা সবাইকে সমান চোখে দেখেন।
১৯৯৭ সাল থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত পুনর্বাসিত পরিবারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮ হাজার ৩টি পরিবার। পরিবারের সদস্য ৫ জন ধরে হিসাব করলে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ১৫ জন। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ একক গৃহের সংখ্যা ১ লাখ ৮২ হাজার ৮০৩টি। আর বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৯৭১ কোটি ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।