টাকার মান ধরে রাখতে বছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে কিনেছে ৫৫০ কোটি ডলার। এ অর্থ প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার সমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগে উপকৃত হয়েছেন রফতানিকারক ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সুবিধাভোগীরা।
জানা গেছে, গত মার্চের পর থেকে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়েছে। রফতানি আদেশ রাতারাতি স্থগিত হতে থাকে। আবার বিদেশী ক্রেতারা অনেক রফতানি আদেশ বাতিল করে দেন। একই সাথে পাইপলাইনে থাকা রফতানি আয় আসাও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ও অস্বাভাবিক হারে কমে যায়। এ দিকে কাজকর্ম হারিয়ে বিদেশ থেকে শ্রমিক ফিরে আসতে থাকেন। তাদের দীর্ঘ দিনের জমানো অর্থ একসাথে নিয়ে আসায় রেমিট্যান্স অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়, অপর দিকে আমদানি ব্যয় কমে যায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে যায়। এ সময় বেকায়দায় পড়ে যায় ব্যাংকগুলো। যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে আসতে থাকে ব্যাংকগুলোর কাছে তা বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। বাজারে চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো তা বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছিল। এমনি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংক কিনতে থাকে।
প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে মজুদ করে রাখতে পারে না। ব্যাংকগুলোর মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত মজুদ থাকলে দিন শেষে হয় তাকে বাজারে বিক্রি করতে হবে, নতুবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোকে জরিমানা গুনতে হয়। করোনার প্রভাবে বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের চাহিদা কমে যায়। বাজারে বিক্রি করতে না পারায় ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।
একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক এ বিষয়ে গতকাল শনিবার নয়া দিগন্তকে জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দরে ডলার না কিনলে ডলারের মান পড়ে যেত। এতে শক্তিশালী হতো টাকার মান। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন রফতানিকারক ও প্রবাসী বাংলাদেশীরা। সাধারণত. টাকার মান বাড়লে আমদানি ব্যয় কমে যায়। এতে স্থানীয় বাজারে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমে যায়। সস্তায় জিনসপত্র পাওয়া যায়। কিন্তু করোনার প্রভাবে দেশে ও বিদেশে ভোগব্যয় কমে যায়। এতে অভ্যন্তরীণ বাজারে কমে যায় পণ্যের চাহিদা। ভোগ কমে যাওয়ায় স্থানীয় শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। ফলে টাকা বেড়ে গেলেও তেমন কোনো সুফল পাওয়া যেত না। কিন্তু বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তেন প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক ও রফতানিকারকরা।
এমন অবস্থায় ডলারের মান পড়ে গেলে রফতানিকারকদের আয় কমে যেত। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কেনা রফতানিকারক ও প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কিনেছে প্রায় ৫৫০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার সাড়ে ৮৫ টাকা হিসাবে)। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে বড় কোনো হেরফের হয়নি। যেমন গত ১ জুলাই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সা ব্যয় হয়েছে, সেখানে গত ৩১ ডিসেম্বর এসে লেনদেন হয়েছে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার না কিনলে তা ৮০ টাকার নিচে নেমে যেত। ডলার কেনায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও চার হাজার ৩০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে; যা দেশের ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। গত বছর ছিল তিন হাজার ২৫০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিকারকদের কথা চিন্তা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনা অব্যাহত রাখবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত চাহিদা না বাড়ে ততক্ষণ এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।