ডেস্ক নিউজ
দুই বছরের মধ্যে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান
শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ
ইভ্যালি ইঅরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারবে না
মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার মুগদাপাড়ায় নিজের বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন ব্যাংক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। ভাইরাস সংক্রমণরোধে এই পরিবারের অন্য সদস্যরাও খুব বেশি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না। এ অবস্থায় ঘরে বসেই চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি মিজান সাহেব সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর কেনাকাটা করছেন অনলাইনে। ডিজিটাল বাণিজ্যের কল্যাণে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজি, ওষুধ, এমনকি পশুপাখি এবং এ্যাকুরিয়ামের মাছের খাবারও এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। শুধু মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে ই-কমার্স সাইটে প্রবেশ করে চাহিদামতো অর্ডার করলেই চলে আসছে সেই কাক্সিক্ষতপণ্য। সময়ের প্রয়োজনে ডিজিটাল কমার্স খাত দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। আগামী এক বছরের মধ্যে ডিজিটাল কমার্স খাতে বাণিজ্যের পরিমাণ ২৬ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এ খাতে নতুন করে কর্মসংস্থান হবে ৫ লাখ মানুষের। ডিজিটাল বাণিজ্যে দেশে বিপ্লব ঘটে যাওয়ার কারণেই এই সাফল্য আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে গত ১২ বছরে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা, কর্মসংস্থান, উদ্ভাবনসহ সকল ক্ষেত্রেই ব্যবহার হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সমাধান। এক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রুত এগিয়ে গেছে ডিজিটাল বাণিজ্য বা অনলাইনে কেনাকাটা। গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই এখন অনলাইনে সেবা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে ব্যবসা বাড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। তবে নতুন এই ব্যবসা নিয়ে দেশে বিতর্কও কম নয়। আছে ঝুঁকিও। হালের ইভ্যালি, ইঅরেঞ্জ, রিংআইডি ও কিউকম ডটকমের মতো বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানেগুলোর জন্য চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছে ডিজিটাল কমার্স খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই ডিজিটাল বাণিজ্য সম্প্রসারণ হওয়ার সুযোগ আরও বাড়াতে হবে। ডিজিটাল বাণিজ্যের নামে গ্রাহক ঠকানো, প্রতারণা, ভোক্তাদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মতো কারসাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্ডার মতো গ্রাহক পণ্য পাচ্ছেন কিনা তা যাচাইয়ে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। ডিজিটাল কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি সমন্বিত আইন প্রণয়ন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, দেশে ই-ক্যাবের তালিকাভুক্ত ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৬০৯টি। এছাড়া মোট ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০টি। ফেসবুক কমার্সের সংখ্যা ২ লাখ। এ সকল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চলতি বছর শেষে ২০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে লেনদেন বেড়ে দাঁড়াবে ২৬ হাজার কোটি টাকায় এবং ইতোমধ্যে এ খাতে ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে ও আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই খাতে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে বেশকিছু কর্মসূচী বাস্তবায়ন হচ্ছে দেশে। রূপকল্প-২০২১ অধীনে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সারাদেশের ১৮ হাজার ৪৩৪টি সরকারী দফতর এবং ২ হাজার ৬০০ ইউনিয়নে অপটিক্যাল ফাইভার ক্যাবলের মাধ্যমে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে শহর ছাপিয়ে গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত ডিজিটাল বাণিজ্য সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গবর্নেন্স বাস্তবায়ন, আইসিটি শিল্পের বিকাশ ও উদ্ভাবনে পাঁচটি স্তম্ভকে কেন্দ্র করে সরকার জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
তিনি জানান, নতুন উদ্যোক্তা বিশেষ করে স্টার্টআপদের কো-ওয়ার্কিং স্পেস প্রদান ও বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি। এছাড়া ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড এবং স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড নামে ২টি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তাদের সমিতি বেসিসের নেতা লুনা সামসুদ্দোহা মনে করেন, মহামারীর সময় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য টিকে থাকাটা যখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রযুক্তিকে নির্ভর করে গড়ে ওঠা ব্যবসা খাত নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। এর ফলে যে কেবল যিনি পণ্য বানাচ্ছেন বা আমদানি করে আনছেন, তিনিই লাভবান হচ্ছেন এমন নয়। এর সঙ্গে ওই পণ্যটি ক্রেতার হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়েকটি ধাপে নতুন কর্মী তৈরি হচ্ছে। যে ডেলিভারি দেয়, যে পরিবহন সেটা নিয়ে যায়- এসব জায়গায়ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।
ডিজিটাল বাণিজ্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল বাণিজ্য এক সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাত। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় ও আইনী কাঠামোর নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, কেনাকাটার সবটা যে প্রচলিত বাজার বা শপিংমলেই হতে হবে, তা নয়। চাইলে উল্লেখযোগ্য অংশ ভার্চুয়াল মার্কেটপ্লেসে নেয়া যায়। তবেই বাজারে ভিড় কমবে, করোনা সংক্রমণও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, খুচরার পাশাপাশি পাইকারি কেনাবেচাও অনলাইন বাজার ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা দরকার। দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ লাইন বজায় রাখতে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী কুরিয়ার সার্ভিসের ঘাটতি আছে। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ট্রেনের পাশাপাশি ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানে করে কম খরচে খুচরা ও পাইকারি পণ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এদিকে, করোনার এই সময়ে ইভ্যালিসহ বহু বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলেও সেগুলো শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। গ্রাহক ঠকানোর দায়ে এ ধরনের অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আর ব্যবসা করতে পারবে না। তবে ডিজিটাল বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ডিজিটাল কমার্স ব্যবসার সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য একটি বৈঠক করা হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইসিটি ডিভিশনের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে সকল ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল কমার্স খাতে মনিটরিং জোরদারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআইয়ের পক্ষ থেকে যত দ্রুত সম্ভব একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেল কর্তৃক ডিবিআইডি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনিয়মের নজরদারির পদ্ধতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কর্তৃক সেন্ট্রাল কমপ্লেইনস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস (সিসিএমস) এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ধীন বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক সেন্ট্রাল লজিস্টিক ট্র্যাকি প্ল্যাটফর্ম (সিএলটিপি) বাস্তবায়নের সুযোগ থাকবে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান তাদের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করবে।
জানা গেছে, এটুআইকে সরকারী ক্রয় বিধিমালা ২০০৮-এর ১২(১) বিধি অনুযায়ী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনিয়মের নজরদারির পদ্ধতি এবং সেন্টাল কমপ্লেইনস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সিসিএমস প্রস্তুত করার কার্য অর্পণ করে পত্র দেয়া হয়। এটুআই ইতোমধ্যে ডিবিআইডি এবং সিসিএমএস প্রস্তুত করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক অতি দ্রুত এসক্রো সেবা স্বয়ংক্রিয় অটোমেশন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ফেসবুক কমার্সের ক্ষেত্রে সাধারণত কোন লাইসেন্স গ্রহণ করা হয় না। তবে ডিজিটাল কমার্সের ক্ষেত্রে ডিবিআইডি নাম্বার নিতে হবে। ডিজিটাল কমার্স বিষয়ে একটি সমন্বিত আইন প্রণয়ন করা হবে। এছাড়া ডিজিটাল কমার্স অথরিটি অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দিয়েছন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ওই বৈঠকে নিবির মনিটরিংয়ের মাধ্যমে যেকোন অনিয়মের ক্ষেত্রে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, সকল ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানকে ডিবিআইডি দেয়া, পেমেন্ট সিস্টেম অটোমেশন করা, সমন্বিত অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম তৈরি করা এবং ই-ক্যাবের মাধ্যমে তদারকি জোরদার করার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিশেষ উদ্যোগ ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি সভা হয় গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি) এএইচএম সফিকুজ্জামানের নেতৃত্বে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহ তদারকি ও পরিবীক্ষণের আওতায় আনায়ন এবং অনৈতিক ব্যবসার ফলে যেসকল ভোক্তা প্রতারিত হয়েছেন তাদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি কার্যপরিধি ই-কমার্স সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগ অধিদফতর ও সংস্থাসমূহের একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আনায়ন এবং তাদের মধ্যে ইন্টার অপেরাবিলিটি নিশ্চিতকরণ, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহকে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সের আওতায় আনার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছে। সম্প্রতি অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের তথ্য এবং মালিকানাধীন সম্পদের বিবরণ, ব্যাংক হিসাবের স্থিতি হালনাগাদ তথ্যপ্রাপ্তি এবং উক্ত অর্থ ও সম্পদ রিকোভারি করার পদ্ধতি নির্ধারণ, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ও পরিবীক্ষণের লক্ষ্যে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহের সকল আর্থিক লেনদেন তদারকির আওতায় আনা এবং ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট ট্যাক্সের আওতায় আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ কমিটি গত বছরের ১১ নবেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রিপোর্ট দাখিল করে।
অনলাইনে যেকোন ধরনের জুয়া, বেটিং বা লটারি আয়োজন থাকছে না ॥ ২০২০ সালের ১৪ জুলাই ইভ্যালির বিরুদ্ধে জুয়া, বেটিং এবং লটারির নামে প্রতারণার বিষয়ে একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি দ্বারা তদন্ত করানো হয়। তদন্তে অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতরকে চিঠি পাঠানো হয়। গত বছরের ৪ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ জারি করা হয়। এছাড়া ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮-এর আলোকে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কারণে আগামীতে অনলাইনে ব্যবসায় আর জুয়া, বেটিং এবং লটারির মতো কোন কর্মসূচী গ্রহণ করে ভোক্তা আকর্ষণ করার সুযোগ থাকছে না। ইতোমধ্যে ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কারিগরি কমিটি ও উপদেষ্টা কমিটি নামে দুটি কমিটি এ খাত উন্নয়নে কাজ করছে। কারিগরি কমিটি বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে সভা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকে। উপদেষ্টা কমিটিও মাঝে মাঝে সভা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকে। এছাড়া ই-কমার্স খাত নিয়ে গত ২৫ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে পেমেন্ট গেটওয়েতে যেসকল গ্রাহকের টাকা আটকে আছে, তা অতি দ্রুত গ্রাহকের নিকট ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অগ্রগতি কিউকম গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে। সিআইডিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযুক্ত ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ডিফ্রিজ করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধপত্র প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় আইনসমূহ ॥ বাংলাদেশে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার জন্য জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০১৮ (২০২০ সালে প্রথম সংশোধন) প্রণয়ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১ করা হয়েছে। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০১৯, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আইন-২০১২, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট ২০১৮ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিপত্রসমূহ এবং পেনাল কোড ১৮৬০, কোম্পানি আইন ১৯৯৪সহ দেশের অন্যান্য আইন ডিজিটাল কমার্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি পার্সনের নিকট পণ্য হস্তান্তর করা এবং একই শহরে অবস্থান করলে ৫ দিনের মধ্যে ও ভিন্ন শহরে বা গ্রামে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য না থাকলে অগ্রিম মূল্য গ্রহণ না করা এবং ওয়েবসাইটে পণ্যের স্টক প্রদর্শন করা ও কোন পণ্য প্রস্তুত করার অর্ডার গ্রহণের ক্ষেত্রে পণ্য মূল্যের সর্বোচ্চ ১০-এর অধিক গ্রহণ না করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতীত কোন ধরনের ডিজিটাল ওয়ালেট সৃষ্টি না করা এবং গ্রাহকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন কোন পণ্য ক্রয়ে বাধ্য করা যাবে ন।
ডিজিটাল বাণিজ্যে ডিবিআইডি বাধ্যতামূলক ॥ ই-কমার্স খাতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ডিবিআইডি) চালু করা হয়েছে। এটি ফেসবুক ছাড়া সকল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে সহজে নজরদারির মধ্যে আসবে বহুল বিতর্কিত এই খাত। ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর থেকে একটি নিবন্ধন নিতে হবে এ খাতের উদ্যোক্তাদের। সম্প্রতি সচিবালয়ে নিবন্ধন নেয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ইতোমধ্যে ১১টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের হাতে ডিবিআইডি সনদ তুলে দেয়া হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেকোন সময় যেকোন উদ্যোক্তা ব্যবসা পরিচালনার জন্য এ প্রক্রিয়ার মধ্যে সংযুক্ত হতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জনকণ্ঠকে বলেন, এটা আপাতত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যারা ব্যবসা করত তাদের এক ধরনের স্বীকৃতি হিসেবে এই সনদ দেয়া হচ্ছে। এই সনদ দিতে গিয়ে হয়ত অনেক ভুলত্রুটি দেখা দেবে। ধীরে ধীরে আমরা সেগুলোর সমাধান করব। এটা পাইলটিং ভিত্তিতে শুরু হলো। যারা এই নিবন্ধনের আওতায় আসবে না, ভবিষ্যতে সরকার তাদের দায়দায়িত্ব নেবে না। তিনি বলেন, ডিবিআইডি দিয়ে আমরা শুরু করলাম। পর্যায়ক্রমে ই-কমার্স খাতের জন্য আরও বিভিন্ন পদ্ধতি চালু করা হবে।
ডিবিআইডির গুরুত্ব তুলে ধরে সালমান এফ রহমান বলেন, ডিবিআইডি চালুর মাধ্যমে ই-কমার্স সেক্টরে একধাপ অগ্রগতি হলো। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী যারা আছেন, যারা নারী উদ্যাক্তা আছেন তাদের জন্য আমি মনে করি এই প্ল্যাটফর্মটা ভাল একটা উদ্যোগ। এটি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালভাবে, সুন্দরভাবে করার জন্য সহযোগিতা করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জনকণ্ঠকে বলেন, ই-কমার্স ব্যবসায় যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ চারটি পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। ডিবিআইডি তার একটি কার্যকর প্রথম পদক্ষেপ। এরপর আমরা এ খাতের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সার্ভার চালু করব। ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার বলেন, দেশে ফেসবুক, অনলাইনভিত্তিক অনেক ভাল ভাল প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতারণার কারণে তার দায়ভার সব ই-কমার্স খাতে পড়ছে। ই-কমার্স খাতকে প্রতারণা থেকে দূরে রাখতে এবং এর ভবিষ্যত সুষ্ঠু পরিচালনার মাধ্যমে আরও প্রসারের লক্ষ্যে যে ডিবিআইডি কার্যক্রম শুরু হচ্ছে, আশা করছি এতে ই-কমার্স তার সম্ভাবনা মেলে ধরতে সক্ষম হবে।