ডেস্ক নিউজ
ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে দেশের মানুষ। গ্রাহক যাতে খুব সহজে ঘরে বসেই সব ধরনের আর্থিক লেনদেন করতে পারেন, সে জন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি কমন প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী জুনেই ইন্টার-অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফর্ম (আইডিটিপি) নামে ইলেকট্রনিক পেমেন্টের সর্বাধুনিক এই ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
এর আওতায় দেশের সব তফসিলি ব্যাংক, মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস) ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রভাইডাররা (পিএসপি) যুক্ত থাকবে। এ ছাড়া সরকারি ইউটিলিটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ট্যাক্স অথরিটি, বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসহ (মার্চেন্ট) ই-পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানে সরাসরি সংযোগের ব্যবস্থা থাকবে। ফলে এসব সেবার আওতাধীন গ্রাহকরা ঘরে বসেই সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টাই লেনদেন করার সুযোগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি লেনদেন সম্পাদন হতে লাগবে সর্বোচ্চ ৪৫ সেকেন্ড। এ ছাড়া কার্ডভিত্তিক লেনদেনও এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির চিন্তা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে পাইলট টেস্ট সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই সেবায় কাকে, কতটুকু চার্জ গুনতে হবে সেটি এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। প্ল্যাটফর্মটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর আগেই এই চার্জ নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশে ডিজিটাল লেনদেনের যতগুলো ব্যবস্থা আছে তার সমন্বিত প্লাটফর্ম হবে আইডিটি, যা পেমেন্ট ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে। কারণ আইডিটি প্ল্যাটফর্মে দেশে কার্যরত সব ই-ওয়ালেট, মোবাইল ওয়ালেট (এমএফএস হিসাব) এবং ব্যাংক হিসাব যুক্ত থাকবে। ফলে ব্যাংক থেকে নিজের মোবাইল ফোনে টাকা আনা, নিজের মোবাইল থেকে ব্যাংকে টাকা জমা করা, এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে টাকা স্থানান্তর, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল, ঋণের কিস্তি এবং স্কুল-কলেজের বেতন পরিশোধ, হোটেল বুকিং, ট্রেন, লঞ্চ ও বিমানের টিকিট কাটা—সবই করা যাবে ঘরে বসেই। এতে গ্রাহকদের সময় বাঁচবে, কমবে ভোগান্তি। ফলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বিপ্লব ঘটবে। অন্যদিকে ক্যাশলেস সমাজ গঠন আরো বেগবান হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক খোন্দকার আলী কামরান আল জাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা একেবারে নতুন এবং ভিন্ন ডিজিটাল ট্রানজেকশন সিস্টেম। এ ব্যবস্থা চালু হলে ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপির গ্রাহকরা একে অপরের মধ্যে অর্থ স্থানান্তরের সুযোগ পাবেন। বর্তমানে এই তিন সেবার গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি, যারা এর আওতায় চলে আসবে। বিদ্যমান আর কোনো সিস্টেমে এত বেশি কাভারেজ নেই। এ ছাড়া এই ব্যবস্থায় নিমিষেই লেনদেন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে প্রায় ১১ কোটি।এমএফএস অ্যাকাউন্ট আছে প্রায় ১০ কোটি। আর পিএসপি অ্যাকাউন্ট আছে ছয় লাখ। ফলে এক সিস্টেমেই সবার কাভারেজ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ বিদ্যমান গ্রাহকদের পাশাপাশি নতুন করে যে কেউ কোনো একটি মাধ্যমে গ্রাহক হয়ে এখানে যুক্ত হলেই লেনদেন করার সুযোগ নিতে পারবেন।
বেসরকারি ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এই প্ল্যাটফর্ম চালু হলে আর্থিক সেবাটা ইন্টার-অপারেবল হয়ে যাবে। ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি সব গ্রাহক এতে যুক্ত হবেন। ঘরে বসেই তাঁরা অর্থ স্থানান্তরের সুযোগ নিয়ে ডিজিটালি বিভিন্ন লেনদেন করতে পারবেন। এতে ডিজিটাল লেনদেনে যেমন বিস্তার ঘটবে, তেমনি আর্থিক অন্তর্ভুক্তিও ত্বরান্বিত হবে।
জানা যায়, দেশে ডিজিটাল লেনদেনের নতুন প্ল্যাটফর্ম চালুর প্রকল্পটি অর্থায়ন করছে সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। আর এটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুক্তি হয়। এরপর এই প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানোর কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ। জানা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই) সেবার আদলেই এ ব্যবস্থা দাঁড় করানো হয়েছে। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে সেবাদাতা ১৫টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে পাইলট টেস্ট সম্পন্ন করা হয়েছে। ১২টি ব্যাংক, দুটি পিএসপি ও একটি এমএফএস এই পাইলট টেস্টে অংশ নেয়।
এমএফএসগুলোর মধ্যে আইডিটিপির পাইলট টেস্টে অংশ নেয় ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ। জানতে চাইলে বিকাশের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম কালের কণ্ঠকে বলেন, আইডিটিপি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপির মতো সব আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হবে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইন্টার-অপারেবিলিটিটা সহজ হবে। অন্যদিকে, গ্রাহকদেরও লেনদেন করার বড় সুবিধা তৈরি হবে। অর্থাৎ আইডিটিপির কল্যাণে ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেমটা পরিপূর্ণ হবে। এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বিপ্লব ঘটবে। নগদ লেনদেন কমে যাবে। আর নগদহীন লেনদেনের বিস্তার ঘটবে।
২৪ ঘণ্টা লেনদেনের সুযোগ : এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপির গ্রাহকরা নিজেদের মধ্যে সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা লেনদেন করতে পারবেন এবং এই লেনদেনগুলো তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের হিসাবে প্রতিফলিত হবে। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত লেনদেন নিষ্পত্তির পাশাপাশি সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ একজন গ্রাহক (ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান) আইডিটিপি অ্যাপ বা ওয়েব পোর্টাল ব্যবহার করে এই ব্যবস্থায় রেজিস্ট্রেশন ও লেনদেন সম্পাদন করতে পারবে। তবে এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
কী ধরনের লেনদেনের সুযোগ থাকছে : এই ব্যবস্থায় দুই ধরনের লেনদেন সম্পাদন করার সুযোগ থাকছে। এগুলো হলো ডাইরেক্ট পে (ডিপি) এবং রিকোয়েস্ট টু পে (আরটিপি)। ডাইরেক্ট পের মাধ্যমে গ্রাহক তাঁর হিসাব থেকে অন্য গ্রাহকের হিসাবে অর্থ পাঠাতে পারবেন। অন্যদিকে রিকোয়েস্ট টু পের সাহায্যে অন্যের হিসাব থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন।
রেজিস্ট্রেশন করতে হবে : এ ব্যবস্থায় একজন গ্রাহক একাধিক পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। প্রথমত, গ্রাহক নিজে আইডিটিপি অ্যাপ ব্যবহার করে আইডিটিপি ব্যবস্থার সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের পক্ষ হয়ে রেজিস্ট্রেশন করে দিতে পারবে।
লেনদেনে পিন নম্বর ব্যবহার
গ্রাহক আইডিটিপি অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন সম্পাদন করতে চাইলে প্রতিটি লেনদেনে ছয় ডিজিটের পিন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। তবে গ্রাহক তাঁর প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন সম্পাদন করলে কোনো পিনের প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া আইডিটিপি ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী গ্রাহকের সঙ্গে তাঁর ব্যবহৃত ফোনটি ডিভাইস বাইন্ডিং করা থাকবে।