ডেস্ক নিউজ
রাজধানীর বাইরে নেওয়া হচ্ছে আন্তজেলা বাস টার্মিনাল। সাভারের হেমায়েতপুর, হরিরামপুরের গ্রাম ভাটুলিয়া এবং কেরানীগঞ্জের বাঘাইরে হবে আন্তজেলা বাস টার্মিনাল। এ ছাড়া কাঁচপুরে বাস টার্মিনাল ও সিটি বাস ডিপো নির্মাণ করা হবে। গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদের আন্তজেলা টার্মিনালকে সিটি টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীতে টার্মিনালকেন্দ্রিক যানজট নিত্যসঙ্গী। এই যানজট নিরসন ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীর বাইরে আন্তজেলা বাস টার্মিনাল করার পরিকল্পনা চলছে। হেমায়েতপুর, গ্রাম ভাটুলিয়া ও বাঘাইরে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। আগামী ৫০ বছরে পরিবহনের পরিস্থিতি চিন্তা করে এ টার্মিনালগুলো করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজধানীর ভিতরের এই তিন টার্মিনালকে সিটি বাস টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তাহলে রাস্তায় আর কোনো বাস থাকবে না, যানজটও হবে না। বাস মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। এসব টার্মিনালে যাত্রীদের সার্বিক সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকবে চালকদেরও।’
রবিবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভার আলোচনা সূত্রে জানা যায়, দুই ধাপে এই বাস টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ করা হবে। প্রথম ধাপে বাঘাইর, কাঁচপুর দক্ষিণ, গ্রাম ভাটুলিয়া ও হেমায়েতপুরে আন্তজেলা বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। কাঁচপুর উত্তরে ও ভাওয়াল আটি বাজারে সিটি বাস ডিপো তৈরি করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে ভুলতায় আন্তজেলা টার্মিনাল এবং কাঞ্চন এলাকায় সিটি বাস ডিপো তৈরি করা হবে। এ প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ ২০২৫ সালের মধ্যে এবং দ্বিতীয় ধাপের কাজ ২০৩০-৩৫ সালের মধ্যে শুরু হবে বলে জানা গেছে।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের জন্য হেমায়েতপুরে ৪৫ দশমিক ১৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এতে খরচ পড়বে ৭ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বাঘাইরে সরকারি মালিকানাধীন ৩৩ দশমিক ৬৩ একর জমি অধিগ্রহণে খরচ ধরা হয়েছে ৮১২ কোটি টাকা। কাঁচপুর উত্তরে বাস ডিপোর জন্য সরকারি মালিকানাধীন ১৫ দশমিক ৫ একর জমি অধিগ্রহণে খরচ পড়বে ৭৮৮ কোটি টাকা। কাঁচপুর দক্ষিণে ব্যক্তিমালিকানাধীন ২৭ দশমিক ৭০ একর জমি অধিগ্রহণে খরচ হবে ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। ভুলতায় ২৪ দশমিক ২ একর সরকারি জমি অধিগ্রহণে খরচ ধরা হয়েছে ৯৪২ কোটি টাকা। কাঞ্চনে ২৪ দশমিক ২ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণে খরচ হবে ১ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। গ্রাম ভাটুলিয়ায় ২৬ দশমিক ৫০ একর সরকারি জমি অধিগ্রহণে খরচ ধরা হয়েছে ৩১৪ কোটি টাকা। আটি বাজারে ২৫ দশমিক ৭৮ একর সরকারি জমি অধিগ্রহণে খরচ ধরা হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের নকশা সূত্রে জানা যায়, হেমায়েতপুর আন্তজেলা বাস টার্মিনালের নকশায় টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে কার/মাইক্রোবাস রাখা যাবে ৪৬টি, সিএনজি ৪৮টি, মোটরবাইক ৩৪ ও সিটি বাস ৫১। আন্তজেলা বাস প্রবেশের বে থাকবে ১২৫ এবং বাস বের হয়ে যাওয়ার বে ১২৫। ১২০টি বাস পার্কিংয়ে রাখা যাবে। গ্রাম ভাটুলিয়ায় বাস টার্মিনালের পরিকল্পনায় কার/মাইক্রোবাস রাখা যাবে ৩৪টি, সিএনজি ৭০টি, মোটরবাইক ৩০টি, সিটি বাস ৩২টি, আন্তজেলা বাস প্রবেশের বে ৬৪টি এবং বের হওয়ার বে থাকবে ৬৪টি। ৮৬টি বাস পার্ক করে রাখা যাবে। বাঘাইরে পরিকল্পনাধীন টার্মিনালের নকশায় কার/মাইক্রোবাস রাখা যাবে ৪৬টি, সিএনজি ৪৮টি, মোটরবাইক ৩৪টি, সিটি বাস ৩৩টি, আন্তজেলা বাস প্রবেশের বে ৭২টি এবং বের হওয়ার বে ৭২টি। ২২৪টি বাস পার্কিংয়ে রাখা যাবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বাস মালিক সমিতির সঙ্গে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির দফায় দফায় বৈঠক চলছে। রাজধানী জুড়ে যানজটের অন্যতম কেন্দ্র টার্মিনাল। টার্মিনালে গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘিরে সকাল থেকে শুরু হয় যানজট। এই যানজট ছড়িয়ে পড়ে শহর জুড়ে। দূরপাল্লার গাড়ি শহরের ভিতরে আসায় উত্তরা, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও এলাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে যানজটের সৃষ্টি হয়। অফিসগামী মানুষের কাছে এই রুট দিনে দিনে হয়ে উঠছে বিভীষিকা। তেজগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত ইউটার্ন নির্মাণ করেও যানজট কমাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। টার্মিনালের বাইরে বাস রেখে রাস্তা দখল করে রাখেন মালিক-শ্রমিকরা। তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে প্রতিদিন তেজগাঁও থেকে উত্তরা গিয়ে অফিস করতে হয়। সকালে মহাখালী টার্মিনাল থেকে বাস বেরোনোর জন্য টার্মিনালের সামনে রাস্তা আটকে রাখা হয়। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।’ অফিস সময়ে গাড়ির চাপে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়। এ টার্মিনাল সরিয়ে নিলে এখানে সকাল-বিকাল দুই ঘণ্টার যে তীব্র যানজট, এর অবসান হবে। গাবতলী বাস টার্মিনালের কারণে টেকনিক্যাল মোড়, কল্যাণপুর ও মিরপুর-১-এর মাজার রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। সায়েদাবাদ এলাকারও একই অবস্থা। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর আরেকটি মিটিং আছে। টার্মিনাল সরানোর ব্যাপারে আমরাও একমত। ঢাকা শহর আর আগের মতো নেই। যখন এই টার্মিনাল তৈরি হয়েছিল তখন ঢাকা শহরে ৩০-৪০ লাখ মানুষ বাস করত। এখন ২ কোটির বেশি মানুষের বাস এখানে। রাজধানীর যানজট নিরসনে আমি মনে করি টার্মিনাল সরানোর প্রয়োজন আছে।’ তবে টার্মিনাল সরানোর চেয়ে বাসের চলাচল ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন উল্লেখ করে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘টার্মিনাল সরানোর পরিকল্পনা উন্নয়নমূলক কিন্তু এ পরিকল্পনা হতে হবে অপারেশনাল। টার্মিনালে বাস বসিয়ে রাখার সংস্কৃতি থেকে না বেরোলে যত বড় টার্মিনালই বানানো হোক তাতে জায়গা হবে না।’ তার পরামর্শ, টার্মিনালে থেমে না থেকে যাত্রী নিয়ে বাস চলতে থাকবে। চালক শিফট অনুযায়ী পরিবর্তন হবে। তিনি বলেন, ‘কোম্পানিভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় যেতে পারলে যাত্রীর জন্য বাস বসিয়ে রাখতে হতো না। লন্ডনের মতো ব্যস্ত শহরে ভিক্টোরিয়া বাস টার্মিনালে সর্বোচ্চ ১০-১২টি বাস রাখা যায়। বাকি বাস শহর জুড়ে সার্ভিস দিতে থাকে। সেখানে কোনো যানজটও হয় না। বাস এভাবে বসিয়ে রাখলে মূলধনেরও বড় ক্ষতি হয়। পরিবহন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না এনে শুধু টার্মিনাল সরিয়ে দূরে নিয়ে যাওয়া কোনো বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত হতে পারে না।’