নিউজ ডেস্ক :
দেশে তামাক চাষের আওতায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৬ একর। বিভিন্ন পক্ষের সচেতনতার প্রভাবে সর্বশেষ অর্থবছরে তামাক চাষের আওতায় জমির পরিমাণ নেমেছে ১ লাখ ৪ হাজার ৯১৪ একরে। জমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ায় আকার বাড়ছে তামাক অর্থনীতির।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে তামাক উৎপাদিত হয়েছে ৮৯ হাজার মেট্রিক টন। দুই বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৮৭ হাজার ৬২৮ হাজার টন। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অপ্রচলিত ফসলের চাষাবাদ নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
তামাকের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি এ মরণনেশা সেবনের প্রবণতা, তামাকের পেছনে অর্থ ব্যয়ও বাড়ছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। এ কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই সারা বিশ্বের মতো আজ বাংলাদেশেও পালন করা হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস।
পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্র জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট ১২ হাজার ১১৪ কোটি টাকার তামাকপণ্য ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যবহার হয়েছে ১৭ হাজার ৪৪২ কোটি টাকার তামাকপণ্য। গত অর্থবছর তামাক খাত থেকে কর বাবদ সরকারের আয় হয়েছে আরো ২২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তামাকের অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকায়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন অর্থবছরে তামাক সেবনে মোট ব্যয় বেড়েছে ৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্থিরমূল্যে তামাকের ব্যবহার বেড়েছে ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। পরের অর্থবছর তামাকের ব্যবহার বেড়েছে ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ। সর্বশেষ গত অর্থবছর তামাকের ব্যবহার বেড়েছে ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এ সময়ে বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দাসহ বিভিন্ন উপায়ে তামাকসেবীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭৮ লাখে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে’ শীর্ষক জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তামাক সেবন করেন। পুরুষদের ৪৬ শতাংশই সিগারেট, বিড়ি, জর্দ্দা বা অন্য কোনো তামাকজাত পণ্য সেবন করছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এর হার ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ।
এতে আরো বলা হয়, দেশের ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানের নেশায় আসক্ত। সংখ্যার বিচারে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লাখ। পুরুষদের ৩৬ শতাংশ ও নারীদের দশমিক ৮ শতাংশ ধূমপানে আসক্ত। এর মধ্যে দেড় কোটি প্রাপ্তবয়স্ক সিগারেট সেবন করে থাকেন। অবশিষ্ট ৫৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক বিড়ির নেশায় আসক্ত।
ধোঁয়াযুক্ত তামাক তথা ধূমপানে পুরুষরা এগিয়ে থাকলেও ধোঁয়াবিহীন তামাকে দেশের নারীরাই এগিয়ে আছে বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের ২০ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে থাকেন। সংখ্যার বিচারে অধূমপায়ী তামাকগ্রহীতা ২ কোটি ২০ লাখ। পুরুষদের ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ ও নারীদের ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশই ধোঁয়াবিহীন তামাকসেবী।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে বলেন, তামাক খাত থেকে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সরকারি কোষাগারে আসে। এ রাজস্ব সরকারি আয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাজস্ব আদায়ের পরিধি বাড়িয়ে তামাকের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তামাকের ব্যবহার কমাতে কৃষি খাতের আধুনিকায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণ সময়ের দাবি। সেই লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।
এ বিষয়ে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়দুল্লাহ বাকী বলেন, ক্যানসার রোগের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম তামাক সেবন। এ ছাড়া তামাকের কারণে বেশ কিছু জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। ধূমপান প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ আরো জোরদার করতে হবে। এছাড়া এ-সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগেরও পরামর্শ দিয়েছেন এ ক্যানসার বিশেষজ্ঞ।
তামাকবিরোধী জাতীয় প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এ বিষয়ে বলেন, তামাক সেবনের ফলে দেশের যুবসমাজ প্রথমে তামাকের প্রতি এবং পরে মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর তামাকজাত পণ্যে কর বৃদ্ধি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
এ বিষয়ে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, কার্যকর কর ও মূল্য পদক্ষেপের অভাবে বাংলাদেশে তামাকপণ্যের দাম অত্যন্ত কম। ফলে দেশের তরুণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী খুব সহজেই তামাক ব্যবহার শুরু করতে পারে। আসন্ন বাজেটে কার্যকর করারোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের দাম জনগণ, বিশেষ করে তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
তামাকসেবীদের বড় একটা অংশ নেশা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে দাবি করেছে বিবিএস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ধূমপান করছেন এমন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৬৬ দশমিক ২০ শতাংশ মানুষ গত এক বছরে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। তামাকসেবীদের মধ্যে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এদিকে অন্যান্য দেশের পাশাপাশি আজ বাংলাদেশেও বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তামাক এবং ফুসফুস স্বাস্থ্য’। ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতিবছর ৩১ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এর সহযোগী সংস্থাগুলোর উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ফুসফুসের সুস্থতা এবং সব ধরনের তামাকপণ্য থেকে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে জনগণ, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।