ডেস্ক নিউজ
করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতির হার আরও কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই হার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। চলতি বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা গেলে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের মতো নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে বলে মনে করছে সরকার। এলক্ষ্যে নতুন বাজেটে খাদ্যপণ্য আমদানিতে সহায়ক শুল্ককর ও ভ্যাট নীতি অবলম্বন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি প্রদান এবং বাজার মূল্যের চেয়ে কমদামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম বেগবান করা হবে। জানা গেছে, করোনার কারণে গত এক বছরে সীমিত আয়ের মানুষের আয় উপার্জন কমে গেছে। অন্যদিকে চাল আটা, চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। পেঁয়াজের দাম বাড়লেও দেশীয় উৎপাদন ও আমদানির কারণে এখন বাজারে এই পণ্যটির দাম কমেছে। আগামী এপ্রিলে রোজা সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় আগামী বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে অর্থবিভাগ। আগামী জুন মাসে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হবে। বাজারে সারাবছর যাতে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকে সেই কৌশল নেয়া হচ্ছে বাজেটে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে জানান, সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখার কৌশল নিচ্ছে সরকার। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চাল, পেঁয়াজ ও চিনির মতো পণ্যের দাম যাতে আর না বাড়ে সেজন্য আমদানি সহায়ক ভ্যাট ও শুল্ককর নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী বাজেটেও এ ব্যাপারে অর্থবিভাগ যাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে সেজন্য আগেভাগে প্রস্তাব করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষের উপার্জন কমে গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সামনে আসছে রোজার মাস। সবমিলিয়ে জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে।
জানা গেছে, বাজারে চাল ও গমের দাম সরবরাহ বাড়াতে আমদানি কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী খাতে আমদানি হচ্ছে চাল। ২০ লাখ টন চালের মজুদ বাড়ানো হবে। এছাড়া আটার দাম নিয়ন্ত্রণে গম আমদানি করছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ভারত থেকে প্রায় ৫ লাখ টন চাল আমদানি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। সামনে আরও চাল আমদানি করা হবে। এছাড়া বেসরকারী খাতে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডালের মতো পণ্য আমদানির পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে আগামী বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। বিশেষ করে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি, সার ও বীজ আমদানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে।
জানা গেছে, গত ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার, গড় মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার কৌশল গ্রহণ করে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় ওই সময়। এরই ধারাবাহিকতায় গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। এটাকে সরকারের অন্যতম অর্থনৈতিক সাফল্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৯ অর্থবছরে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সঙ্গে সঙ্গে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর অগ্রগতির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সফল হয়েছে বর্তমান সরকার। এই সাফল্যেও পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বাজেটে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়। এই হার বাস্তবায়নের পরও দেশে কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ কারণে আগামী বাজেটে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সব ধরনের কৌশল বাস্তবায়ন করবে অর্থবিভাগ। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে দেশজুড়ে লকডাউন ছিল। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হয়ে আসলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পেঁয়াজ আমদানির ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ককর প্রত্যাহার করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে এনবিআরকে নির্দেশ প্রদান করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়। বর্তমান আমদানিকৃত পেঁয়াজ মাত্র ১৫ টাকা কেজি বিক্রি করছে টিসিবি। এছাড়া সম্প্রতি ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই পণ্যটি আমদানিতে ভ্যাট এক স্তরে নামিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার। এর আগে ব্যবসায়ীরা এক স্তরে ভ্যাট নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, ভোজ্যতেলের দাম কমাতে ভ্যাট তিন স্তর থেকে নামিয়ে একস্তরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন আমদানিকারকরা। তাদের প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ভোক্তাদের স্বার্থে যদি ভোজ্যতেলের আমদানি শুল্ক কমানোর প্রয়োজন পড়ে তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও বেকার মানুষ বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে অনেকে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনেকে হেরে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকারকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেটে এখন সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হলো ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানো। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে নগদ সহায়তাসহ যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এগুলো আগামী বছরও অব্যাহত রাখতে হবে। বাজেটে এর প্রতিফলন থাকবে বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানোর আরেকটি উপায় হলো বেসরকারী খাতকে আয়ে ফিরিয়ে আনা।
ভোক্তার অধিকার ও সচেতনতা নিয়ে কাজ করেন এমন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, একদিকে মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানো, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বর্তমান ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ধরে রাখা এ দুটি বিষয়কে সামনে রেখে তৈরি হওয়া উচিত আগামী বাজেট। এ জন্য কর ও শুল্কনীতি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি, বেসরকারী খাতকে আয়ে ফিরিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো ও নিচের দিকে কর হারের স্তর বাড়ানো ইত্যাদি পদক্ষেপ বাজেটে থাকতে হবে।