অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম দারাজ। ‘দারাজ’ একটি ফারসি শব্দ। বাংলায় দারাজ বা দরাজ শব্দটির অর্থ বড়, বিশাল বা উদার। কিন্তু ব্যবসার ধরন ও গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার কারণে তাদের এখন ‘দারাজ প্রতারক’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।
রাজনগদ টাকায় পণ্য পৌঁছে দিলেও পণ্যের মান নিয়ে এন্তার অভিযোগ দারাজের বিরুদ্ধে। বিশেষ ছাড় দেয়ার নামে তারা নিম্নমানের পণ্য গছিয়ে দিচ্ছেন গ্রাহকদের। এই বিশেষ ছাড়কে তাই ‘বিশেষ প্রতারণা’ বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।জানা যায়, ২০১৫ সালে ‘দারাজ বাংলাদেশ’ নামে বাংলাদেশে দারাজের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক দারাজ গ্রুপকে চীনা বহুজাতিক কোম্পানি ও ই-বাণিজ্য জায়ান্ট আলিবাবা গ্রুপ কিনে নেয়। আলিবাবা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন দারাজ ডটকম বিডি বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। দারাজ থেকে পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকার বাসিন্দা মো. সহিদুর রহমান। তিনি দারাজ থেকে দুটি ফাস্ট চার্জার কেনার অর্ডার দিয়েছিলেন। দুটি চার্জারের দাম হিসেবে দারাজ তার কাছ থেকে ১৮০০ টাকা নেয়। কিন্তু তাকে আসল চার্জার না দিয়ে নিম্নমানের দুটি চার্জার দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে আঠারো শ টাকা নেয়া হয়েছিল, কিন্তু আমি চার্জার পেয়েছি একেবারে লো-কোয়ালিটির। সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায় এইগুলো কেনা যেত। আমি অফিস থেকে ই-মেইলটি দিয়েছিলাম। তাই অর্ডার নম্বরটি দিতে পারছি না। তবে অফিসে গেলে দিতে পারব।’
ওয়ারী এলাকার মেহেদী হাসান নামের আরেক গ্রাহক দারাজ থেকে পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি দারাজ থেকে একটি লুঙ্গি কিনেছিলেন। তার অর্ডার নম্বর হচ্ছে-৬০৯০৭৭৫৮৬৮৭৭১০০। সেই লুঙ্গির মান নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার যে লুঙ্গিটার অর্ডার করেছিলাম তার দাম ছিল সাড়ে চার শ টাকা। ডিসকাউন্ট দিয়ে ২৮৭ টাকা নেয়া হয়। কিন্তু প্যাকেট খোলার পর দেখি সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী। ওরা (দারাজ) সেলারদের কাছ থেকে পণ্য এনে দেয়। সেলার ভালো নাকি মন্দ পণ্য দিল, দারাজ এর কোনো খোঁজখবরই রাখে না। দারাজ বলে তারা কোয়ালিটি মেইন্টেইন করে, কিন্তু আসলে ওরা এর কোনো ধার ধারে না।’
ধানমণ্ডি এলাকার গ্রাহক বাবুল। তিনি দারাজ থেকে দুটি প্যান্ট এবং পোলো শার্ট ক্রয় করেন। তার অর্ডার নম্বর হলো- ৬০৮৮৮০৬৭৪২০৯২১। উল্লিখিত অর্ডার আইডি থেকে তিনটি পণ্য কেনেন তিনি। তিনটি পণ্যের মানই পশ্নবিদ্ধ বলে জানান এই গ্রাহক। একটি পোলো শার্টের মূল্য এক হাজার টাকা দেয়া আছে। সেই পণ্যের ছাড় দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে ২২০ টাকা নেয়া হয়। একটি প্যান্টের মূল ১৩৫০ টাকা, ছাড় দিয়ে ২৪০ টাকা এবং আরেকটি প্যান্টের দাম ৭৯৯ টাকা, ছাড় দিয়ে ২২৮ টাকা। প্রতিটি পণ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য ৬০ টাকা করে ১৮০ টাকা নেয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি ফেসবুকে দারাজের বিজ্ঞাপন দেখে দুটি প্যান্ট ও একটি পোলো টি-শার্টের অর্ডার দিয়েছিলাম। এর দুই দিন পর দারাজের অফিস থেকে জানানো হয় পণ্যগুলো আমার কাছে পাঠানো হচ্ছে। ডেলিভারি বয় আমাকে পণ্যগুলো দিতে এলে আমি তা খুলে দেখে নিতে চাই। তখন ডেলিভারি বয় বলেন, ‘এখনে খুলে নিতে পারবেন না। পরে খুলে দেখবেন। সমস্যা থাকলেও রিটার্ন দিতে পারবেন।’ তারপর প্যাকেট খুলে দেখি প্যান্টগুলো একেবারেই লো-কোয়ালিটির। এসব প্যান্ট ভ্যানগাড়িতে যে প্যান্ট বিক্রি করে তার চেয়েও খারাপ। আর পোলো টি-শার্টটির কলারে সমস্যা। তিনটি পণ্যই আমার কাছে মনে হচ্ছে রিজেক্ট মাল।’ তিনি আরো বলেন, ‘দারাজ যে বিশেষ ছাড় দেয় তা আসলে ভাঁওতাবাজি। এক শ টাকার পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিশেষ ছাড় দেয় তারা। আমার মনে হয় ডেলিভারি দেয়ার আগে দারাজের পণ্যের মান নিশ্চিত করা উচিত।’
যাত্রাবাড়ী এলাকার মোহাম্মদ ইসহান মির্জা বলেন, ‘আমি একটি পাওয়ার ব্যাংক কিনেছিলাম। তার মধ্যে একটা পুরনো ব্যাটারি পেয়েছি। এটি তো দেখি দারাজের দরাজ প্রতারণা।’ তার অর্ডার নম্বরটি হলো- ৬০৮৭৩৮৪৯৪৯৩৯৯৬২।
এমন চিত্র শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দারাজ থেকে বিভিন্ন পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকেই। তারা তাদের সমস্যার কথা কাউকেই বলতে পারছেন না। মানহীন পণ্য ফেরত নেয়ার কথা থাকলেও সেই অপশনও বন্ধ করে রেখেছে প্রতারক এই প্রতিষ্ঠানটি।
দারাজ থেকে ডিনার সেট কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন আরেক গ্রাহক মাসুম বিল্লাহ। তার অর্ডার নম্বর হলো- ৬০৯২৪৩৩১০০০৪৬৭০। তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘সাধারণত দারাজের ডাবল টাকা ভাউচার পাওয়া খুব অসাধ্যের একটা বিষয়, অনেক কষ্টে এবার একটা ১০০০ টাকার ভাউচার পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। মা অনেক দিন ধরে একটা ডিনার সেটের কথা বলছেন, তাকে একটা ডিনার সেট কিনে দেই। ৬ টাকায় ডেলিভারি অফার পেয়ে মাকে দারাজের অনেক মডেল দেখিয়ে একটি ডিনার সেট পছন্দ করাই। বাসা বরিশাল উপজেলা পর্যায়ে হওয়ায় ছোট ভাইকে দিয়ে বরিশাল থেকে সেটি রিসিভ করাই এই ভেবে যে, কুরিয়ার উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে আসতে হয়তো ভেঙে ফেলে কি না। আজকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর প্যাকেট খুলেই মায়ের মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আমার কষ্টটা আরো বেশি। কারণ পরিবারের লোকজনের কাছে অনলাইন শপিংকে বিশ্বাসযোগ্য করাতে চেয়েছিলাম, দারাজ তার পুরোটাই ভেঙে দিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ডিনার সেটের মডেল পুরা চেঞ্জ, ওল্ড মডেল, ডিজাইন চেঞ্জ, সঙ্গে ৩২ পিসের জায়গায় ৩১ পিস, মানে কারি বোল দেয়নি। ফ্যামিলিতে মাথা নিচু হয়ে গেল, মা ডিরেক্ট বলে দিছে, অনলাইনে আর কিছু কিনবি না। এত ভারী এই ডিনার সেট আমাকে আবার দেড় শ টাকার বেশি খরচ করে রিটার্ন করতে যেতে হবে। আবার প্যাক করতে গিয়ে মালের ক্ষতি হলে তার দায়ভার কে নেবে! নিজের ছোটখাটো জিনিস হলে ব্যাপারটা এত খারাপ লাগত না, কিন্তু মাকে কিনে দেয়া একটা ব্যাপার এ রকম হবে- মেনে নিতে পারছি না।’
এর আগেও দারাজ থেকে মোবাইল ফোনসেট কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ভাকুড়া গ্রামের আমজাদ হোসেন লিটন। তিনি জেলা শহরের সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে দারাজ থেকে পাঠানো মোবাইল ফোন নিতে গিয়ে প্যাকেট খুলে দেখেন ফোনের বাক্সে তিনটি কাপড় কাচা হুইল সাবান। দারাজের এমন ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। একই রকম ভুক্তভোগী হয়েছেন লক্ষ্মীপুরের পিয়াস সরকার। তিনি অনলাইনে একটি ঘড়ির অর্ডার করেন। এ জন্য পরিশোধ করেন এক হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু প্যাকেট খুলে দেখেন সেখানে ঘড়ির বদলে দুটি পেঁয়াজ।
৬ টাকার ডিল নামেও প্রতারণা: দারাজের আরেকটি প্রতারণার নাম ‘৬ টাকার ডিল’। বাংলাদেশে তাদের ব্যবসার ৬ বছর উপলক্ষে এই ডিলটি দেয়া হয়। তার মধ্যে যারা এই ডিলটি পেয়েছেন তাদের বেশির ভাগই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পুরুষকে দেয়া হয়েছে মহিলাদের জামা, কেউ পেয়েছেন ‘মিস্টি বক্স’ নামে খালি বাক্স। এমনই হাজারো অভিযোগ রয়েছে দারাজের বিরুদ্ধে।
এসব বিষয়ে এই প্রতিবেদক দারাজ বিডি লিমিটেডের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান শায়ন্তী তিশার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ই-মেইলে প্রশ্নগুলো পাঠাতে বলেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) বিকেলে এই কর্মকর্তার ই-মেইলে প্রতারণার বিষয়ে প্রশ্ন পাঠালে গতকাল রাত পর্যন্ত কোনো উত্তর দেননি।
ওয়ারী এলাকার মেহেদী হাসান নামের আরেক গ্রাহক দারাজ থেকে পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি দারাজ থেকে একটি লুঙ্গি কিনেছিলেন। তার অর্ডার নম্বর হচ্ছে-৬০৯০৭৭৫৮৬৮৭৭১০০। সেই লুঙ্গির মান নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার যে লুঙ্গিটার অর্ডার করেছিলাম তার দাম ছিল সাড়ে চার শ টাকা। ডিসকাউন্ট দিয়ে ২৮৭ টাকা নেয়া হয়। কিন্তু প্যাকেট খোলার পর দেখি সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী। ওরা (দারাজ) সেলারদের কাছ থেকে পণ্য এনে দেয়। সেলার ভালো নাকি মন্দ পণ্য দিল, দারাজ এর কোনো খোঁজখবরই রাখে না। দারাজ বলে তারা কোয়ালিটি মেইন্টেইন করে, কিন্তু আসলে ওরা এর কোনো ধার ধারে না।’