ডেস্ক নিউজ
দুর্বল তিন ব্যাংকে কো-অর্ডিনেটর বা সমন্বয়ক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক তিনটি হলো-বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে আরও সাত ব্যাংকে বসানো হবে সমন্বয়ক।
এসব ব্যাংককে উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন সংকট, প্রভিশন ঘাটতি এবং আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণের সীমা লঙ্ঘন করায় দুর্বল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সে কারণেই সমন্বয়ক বসানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, তিনটি ব্যাংকে সমন্বয়ক দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও দুর্বল ব্যাংকে সমন্বয়ক দেওয়া হবে।
জানা গেছে, আর্থিক সূচকে দুর্বল অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাদের (সিএফও) সঙ্গে সভা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সভার পর এসব ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল), বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের সঙ্গে সভা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো কোনোটির সঙ্গে তিন বছর মেয়াদি এমওইউ সই হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংকের সঙ্গে সভা করছে, তার সব কটিই ডুবতে থাকা ব্যাংক।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেসব ব্যাংকের অবস্থা খারাপ, সেগুলোকে বিশেষ তদারকিতে রাখা প্রয়োজন। এজন্য ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্যের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা অনিয়মগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ পরিদর্শনে অনেক ব্যাংকের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণখেলাপিযোগ্য বলে ধরা পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যোগ দিয়েই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পৃথকভাবে তদারকির উদ্যোগ নেন। এরপর ৩ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করা হবে।
সেদিন জানানো হয়, খেলাপি ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশন তথা সঞ্চিতির পরিমাণ-এই চার সূচকের ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের অগ্রগতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ করবেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ আগে রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রধান চার ব্যাংকসহ বেসিক ব্যাংক, বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি করেছে। এর মধ্যে ২০১৫ ও ১৭ সালে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাপক লুটপাটের শিকার বেসিক ব্যাংকে পর্যবেক্ষক দেওয়া হলেও রহস্যজনক কারণে এখন আর তা কার্যকর নেই। এর বাইরে ১৯৯৪ সালে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে এবং ২০২০ সালে ওয়ান ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়। তা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোর অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি ঘটছে না।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে ১০ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, এখন থেকে পর্যবেক্ষকের পরিবর্তে সমন্বয়ক দেওয়া হবে। অর্থাৎ পর্যবেক্ষক ফর্মুলা তুলে দেওয়া হচ্ছে। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইনে সমন্বয়কের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। সেখানে আছে পর্যবেক্ষকের কথা।
সমন্বয়ক বসানো তিন ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফারমার্স ব্যাংক নাম থাকাকালে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মের কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে।
সরকারের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান-ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয়। এরপর এটির নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। ব্যাংকটি এখন ক্ষুদ্র আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারলেও প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
গত জুন শেষে ব্যাংকটির ৫ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৬৭ শতাংশ। পদ্মা ব্যাংকের এডিআর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে ৮৯ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। যদিও এটি প্রচলিত ব্যাংক হিসাবে মোট আমানতের ৮৭ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণ করতে পারে না।
সে হিসাবে ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ করেছে পদ্মা ব্যাংক। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সীমার লঙ্ঘন। এছাড়া গত জুনে পদ্মা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২৬৩ কোটি টাকা। গত জুন শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৯ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৭ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।
পাশাপাশি প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতেও পড়েছে ব্যাংকটি। এছাড়া গত জুন শেষে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৯৮৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪২ দশমিক ০৩ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৩৪৪ কোটি টাকা। ১২১২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতেও রয়েছে ব্যাংকটি।