ডেস্ক নিউজ
বঙ্গবন্ধু সেতু (যমুনা বহুমুখী সেতু) নির্মাণের জন্য রড আমদানি করতে হয়েছিল বেলজিয়াম থেকে। দেশীয় কোম্পানিগুলো তখন ওইমানের রড সরবরাহ করতে পারেনি। এখন স্বপ্নের পদ্মা সেতু হচ্ছে দেশে তৈরি রড দিয়ে।
দেশে বিশ্বমানের যেসব স্থাপনা, সুউচ্চ ভবন, সড়ক অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে তার জন্য নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে হচ্ছে না। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ চলমান মেগা প্রকল্প বহরে যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রী জোগান দিচ্ছে দেশীয় কারখানা।
এছাড়া দেশে চলমান সরকারি বেসরকারি খাতে গুচ্ছ, সহায়ক ও সাধারণ উন্নয়ন প্রকল্পেও দেশীয় নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের আবাসন খাত ও সরকারের অবকাঠামো নির্মাণের ওপর ভিত্তি করে রড, সিমেন্ট, সিরামিক, রং, ইট, বালুসহ ২৬৯টি উপখাত গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে রড, সিমেন্ট, সিরামিক ও রঙে গড়ে উঠেছে বৃহৎ শিল্প। দেশেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের রড-বিলেটসহ ইস্পাত সামগ্রী। ইস্পাত শিল্পে এমন যুগান্তকারী পরিবর্তনে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার চিত্রই উঠে এসেছে। ইস্পাতের পাশাপাশি সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রীতে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এসব সামগ্রী রফতানিও হচ্ছে দেশের বাইরে। চীনে চট্টগ্রাম থেকে বিলেট রফতানি হচ্ছে। প্রতিবেশি ভারত ও নিময়ানমারে রফতানি হচ্ছে রড, সিমেন্ট, সিরামিক। দেশে লক্ষ কোটি টাকার অসংখ্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাতে বেড়েছে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা। এ চাহিদা পূরণে দেশি-বিদেশি বিশাল অঙ্কে গড়ে উঠছে ভারী শিল্প কারখানা। এতে কর্মসংস্থান বাড়ছে, সমৃদ্ধ হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি।
ইস্পাত সিমেন্টের মত ভারী শিল্প কারখানার বেশিরভাগই দেশের প্রধান বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অঞ্চলে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সহজে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামের ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো ক্রমেই বড় হয়েছে। উৎপাদনে বৈচিত্র্যের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে এ খাতে। রড উৎপাদনে দেশের শীর্ষ পাঁচ ইস্পাত কারখানা এখন চট্টগ্রামে। বিনিয়োগকারী শিল্পোদ্যোক্তরা দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। এককভাবে দেশের সবচেয়ে বেশি ইটভাটা চট্টগ্রামে। এখানে পরিবেশ বান্ধব ইটও তৈরী হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিধি ও সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি দ্রুত বে-টার্মিনাল চালু হলে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল আমদানি দ্রুত ও সহজতর হবে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পিগ আইরন, স্ক্র্যাপ ছাড়াও সিমেন্ট ক্লিংকারসহ এসব ভারী শিল্পের কাঁচামাল আসছে। বন্দরে সক্ষমতা বাড়লেও পরিধি না বাড়ায় এসব জাহাজ বার্থিং পেতে সময় লাগছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। বে-টার্মিনাল দ্রুত চালু করা হলে সেখানে বড় বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। আর এসব ভারি শিল্পের কাঁচামাল খালাসের জন্য আলাদা জেটি দেয়াও সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি সরকারের কিছু সহযোগিতা পেলে এ খাত আরো সমৃদ্ধ হবে। ইস্পাত, সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রী রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব হবে।
৫০-এর দশকে চট্টগ্রামে রড উৎপাদন শুরু হয়। জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে পাওয়া লোহা থেকেই গড়ে ওঠে ইস্পাত কারখানা। ধীরে ধীরে এ শিল্প বিকশিত হয়। ৯০ দশকে চালু হয় স্বয়ংক্রিয় কারখানা। স্ক্র্যাপ আমদানির পাশাপাশি দেশেই তৈরি হচ্ছে বিলেট। বিলেট থেকে বিশ্বমানের রড তৈরি করা হচ্ছে। গত অর্থ বছরে রড উৎপাদন হয়েছে ৫৫ লাখ টন। দেশে রড উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে চট্টগ্রামে কেএসআরএম, মোস্তফা হাকিম গ্রুপের গোল্ডেন ইস্পাত এবং এইচএম স্টিল, জিপিএইচ ইস্পাত, একেএস ও বিএসআরএম। দেশের মোট রড উৎপাদনের বেশিরভাগই এ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। এর পাশাপাশি ছোটবড় আরো অনেক ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। ইস্পাত শিল্পের পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিমেন্ট কারখানার দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে রড, সিমেন্টের সিংহভাগ সরবরাহ করছে চট্টগ্রাম।
দেশে বিশ্বমানের যেসব স্থাপনা ও সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে তাতে দেশে তৈরি নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার হচ্ছে। আবাসান খান, উপকূলীয় টেকসই উন্নয়ন এবং ভূমিকম্প সহিষ্ণু স্থাপনা নির্মাণে যাবতীয় সামগ্রী দেশীয় কারখানায় পাওয়া যাচ্ছে। সিমেন্ট উৎপাদনেও এগিয়ে চট্টগ্রাম। সারাদেশের ৩৮টি সিমেন্ট কারখানার মধ্যে ১০টিই চট্টগ্রামে। সিমেন্ট কারখানাতেও যোগ হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। দেশে বিশেষায়িত অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত সিমেন্ট। কারখানাগুলো বিশেষায়িত সিমেন্ট সরবরাহ করছে। চলমান মেগা প্রকল্পগুলোতে চট্টগ্রাম থেকে সিমেন্ট সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
দেশে কয়েক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দরের টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। মীরসরাই-সীতাকুণ্ড ও ফেনীর বিশাল এলাকাজুড়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর ছাড়াও দেশে বেশ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে উঠছে শিল্প কারখানা। কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপে এনার্জি হাব, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ ৬৮টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলমান এসব প্রকল্পে রড, সিমেন্টসহ সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করছেন দেশীয় কারখানা মালিকেরা। বিশেষ করে সাগরতীরের মহেষখালী ও মীরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে স্থাপনা তৈরীতে ব্যবহার করা হচ্ছে লবনাক্ততা সহিষ্ণু সিমেন্ট। তাও সরবরাহ করা হচ্ছে দেশি কারখানা থেকে।
চিটাগাং চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, গত এক দশকে সরকার দেশে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের চাহিদার কারণে দেশে রড, সিমেন্টের মত ভারী শিল্প-কারখানার সংখ্যা বেড়েছে। তাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ খাত এখন সমৃদ্ধ। দেশের চাহিদা পূরণ করে এসব পণ্য এখন বিদেশে রফতানির বিশাল সুযোগ এসেছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে বন্দর সুবিধার পাশাপাশি আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সহজতর করতে হবে।
মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সারওয়ার আলম ইনকিলাবকে বলেন, দেশে বিশ্বমানের যত স্থাপনা তৈরি হচ্ছে তাতে দেশীয় নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার হচ্ছে। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এসব স্থাপনার জন্য আমাদের পণ্যকেই বেছে নিচ্ছেন। পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখতে উদ্যোক্তারাও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করছেন। ইস্পাত এবং সিমেন্ট কারখানার কাঁচামাল আমদানি আরো সহজতর করতে বন্দরের সক্ষমতা এবং পরিধি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত বে-টার্মিনাল চালু করা দরকার। এটি চালু হলে এ দুই ভারী শিল্পের কাঁচামাল খালাস আরো গতিশীল হবে। তাতে উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজনস্কেলের কারণে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভোক্তাপর্যায়ে। একটি ট্রাকে ২০ টন পণ্য পরিবহন করা যায়। কিন্তু ১৩ টনের বেশি পরিবহন করতে গেলে জরিমানা গুণতে হচ্ছে। ট্রাকে ১৩ টন থেকে ১৫ টন এবং লরিতে ২০ টন থেকে বাড়িয়ে ২৫ টন পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ হাকিম আলী বলেন, দেশে সিমেন্টের চাহিদা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণে নতুন নতুন কারখানা হচ্ছে, বিদ্যমান কারখানা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও সিমেন্ট রফতানি হচ্ছে।
রিহ্যাব চট্টগ্রাম রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল কৈয়ূম চৌধুরী বলেন, আবাসন খাতের সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রী দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। এতে করে এ খাতের চাহিদা পূরণে ছোটবড় কল-কারখানা বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে। দেশীয় নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে আবাসন গড়ে ওঠায় ভোক্তাপর্যায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।