ডেস্ক নিউজ
করোনা আর বেশি প্রলম্বিত না হলে কিংবা বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারলে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো তেমন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু করোনা সুনামি যদি সত্যি প্রবেশ করে তাহলে কী ঘটবে সেটি এখন কিছুই বলা যাবে না। সেজন্যই প্রয়োজন সামনের ক’দিন যুদ্ধের মতো সতর্কতা। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেখানেই নানা ঘাটতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতার ছড়াছড়ি আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এ সবই বন্ধ করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এখন ব্যাপকভাবে সংক্রমিত বলে প্রচারিত হচ্ছে। এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার এখন দ্রুতই বেড়ে চলছে। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি এখনো অনেক দেশের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। তবে সংক্রমণ আগের চাইতে বেড়ে চলছে, নতুন নতুন জায়গায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। কতগুলো কারণে এই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নীতিনির্ধারক মহলেও বেড়ে গেছে। এর একটি কারণ হচ্ছে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মধ্যে ঘরে না থাকার প্রবণতা। এছাড়াও বিপুলসংখ্যক মানুষ একবার শহর থেকে গ্রামে সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষা করে যানবাহনের সাহায্য নিয়ে চলে যান, ৪ তারিখ হঠাৎ করে পোশাক শ্রমিকদের বড় একটি অংশ ঢাকায় ফিরে আসে। এছাড়া মসজিদ ও উপাসনালয়ে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া হাট বাজারে ব্যাপক মানুষের সমাগম ঘটছে। সবকিছু মিলিয়ে বাসা বাড়িতে অবস্থান করেন এমন মানুষের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট সীমিত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশে কোভিড-১৯ দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে। তারাও এ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো বাংলাদেশে সংক্রমণ বৃদ্ধি ঘটলে চিকিৎসার সুযোগ চাহিদা মোতাবেক বাংলাদেশে বৃদ্ধি করা মোটেও সম্ভব হবে নাÑ এ কথা সবাই বুঝতে পারলেও সচেতনতার কাজে নিজেকে ঘরে রাখার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষেরই রয়েছে দ্বিচারিতা। সেকারণে এতদিন বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহলের মধ্যে যে ধরনের আস্থা ছিল এখন তা নিয়ে এখন বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েই চলছে। আগামী কয়েকটি দিন করোনা ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি কোনদিকে মোড় নেবে সেটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের বিষয়। সরকার সাধারণ ছুটি আগামী ১৪ তারিখ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। এই সময়ে ঘরে থাকার বিষয়টিকে আগের চাইতে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা দরকার। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে আরো কঠোরভাবে বিধিনিষেধ মেনে চলার বিষয়টিকে কার্যকর ও নজরদারিতে রাখা দরকার। করোনা ভাইরাসকে এই সময়ে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। সেকারণে সরকারের উচিত হবে সামনের দিনগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থাকা এবং নিয়ন্ত্রণের জায়গা ধরে রাখার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার সুযোগ আপাতত দেখি না। ইতোমধ্যে সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে করোনা ভাইরাস নিয়ে নানা ধরনের গুজব বানোয়াট তথা মনগড়া খবরাখবর দেশ এবং বিদেশ থেকে প্রচার করা হচ্ছে। এর ফলে করোনা ভাইরাস নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি, অবহেলা ও ভুল ধারণা লক্ষ করা যাচ্ছে। একদিকে গণমাধ্যমগুলো করোনা সম্পর্কে সেসব করণীয় ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছে, তার বিপরীত প্রচারণা দেয়া হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এর ফলে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনা সচেতনতা প্রত্যাশিতভাবে তৈরি হচ্ছে না। এমন অবস্থাটি দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের বাস্তবতাকে আরো জটিল করে তুলছে। সুতরাং সামাজিক মাধ্যমের ওপর সরকারের কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ বিদেশ থেকে নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রচার করে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারকে এ বিষয়ে আইনানুগ বেবস্থা জোরদার করার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
দেশ যখন করোনা সংক্রমণের নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে তখন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা করোনা-পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার একটি প্যাকেজ গত ৫ এপ্রিল গণমাধ্যমে গণভবন থেকে তুলে ধরেছেন। এতে তিনি ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। দেশের ভারি, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প এই প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সরকারের এই আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণাকে অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মহল সাধুবাদ জানিয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বিশেষত দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটগুলো আরো কয়েকদিন বন্ধ থাকবেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া ও অন্যান্য উপযোগের বিল কীভাবে তারা পরিশোধ করবে সেটি তাদের দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যমগুলো রয়েছে ব্যাপক সংকটে। দৈনিক পত্রিকাগুলো এখন প্রায় বিজ্ঞাপনবিহীন অবস্থায় স্বল্প পরিসরে প্রকাশিত হচ্ছে। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্তের আর্থিক সক্ষমতা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাদের পরিবার কতদিন এই অবস্থায় টিকে থাকতে পারবে সেটি মস্ত বড় প্রশ্ন। সরকার যে অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তার সুফল করোনা-পরবর্তী সময়ে উপরে উল্লেখিত কয়েকটি খাত পেলেও অনেক খাত এবং সামাজিক স্তর সরাসরি পাবে না। ফলে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে। সেকারণে দেশের দোকানপাট ব্যবসা বাণিজ্য এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত বেসরকারি মালিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকে থাকার বিষয়টিও অদূর ভবিষ্যতের বিবেচনায় নেয়া দরকার। যেসব ক্ষুদ্র মাঝারি প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সেগুলোর ভাড়াসহ কিছু কিছু বিষয়ে মালিকদের ভাড়া ছাড় দেয়ার সরকারি আদেশ বা আহ্বান থাকা উচিত। এক্ষেত্রে সরকারি ঋণ গ্রহণে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ভাড়া ছাড় দেয়া মালিকদের অগ্রাধিকার বিবেচিত হতে পারে। গণমাধ্যমের বিষয়টি সরকারের বিশেষ প্রণোদনা তহবিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরি।
সবার আগে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দেশকে বাঁচানোর উদ্যোগটি সফল করতেই হবে। প্রতিবেশী ভারতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েছে, আমাদের এখানেও প্রতিদিনই সেই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সুতরাং করোনা আশঙ্কাকে মোকাবিলায় যুদ্ধকালীন তৎপরতা প্রয়োজনে কার্যকর করতে হবে। সবার আগে করোনা প্রতিরোধ করা, এরপরেই দেশের অর্থনীতিকে সচল করার কাজে সরকার এবং জনগণ যার যার ভ‚মিকা রাখবে এটি প্রত্যাশিত। করোনার সংক্রমণটি এখানেই থামিয়ে দেয়া গেলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশের তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দেশের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা সংকটকালে দেশের হাল ধরে আছেন এটি বাংলাদেশের জন্য মস্ত বড় আস্থার বিষয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে না পারলে বা তেমন নেতৃত্ব সেরকম কারো হাতে না থাকলে আমাদের মতো দেশের পক্ষে বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা মোটেও সহজ কিছু নয়। নেতৃত্বের ঐতিহাসিক ভ‚মিকা সম্পর্কে যারা সচেতন তারা এটি স্বীকার করবেন। করোনা আর বেশি প্রলম্বিত না হলে কিংবা বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারলে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো তেমন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু করোনা সুনামি যদি সত্যি প্রবেশ করে তাহলে কী ঘটবে সেটি এখন কিছুই বলা যাবে না। সেজন্যই প্রয়োজন সামনের ক’দিন যুদ্ধের মতো সতর্কতা। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেখানেই নানা ঘাটতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতার ছড়াছড়ি আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এ সবই বন্ধ করতে হবে।