ডেস্ক নিউজ
এক সপ্তাহের মধ্যেই করোনার টিকা নিয়ে বেশ কয়েকটি সুখবর পেতে পারে দেশ। এ পর্যন্ত বিশ্বে জরুরি প্রয়োগের জন্য অনুমোদন পাওয়া ১২টি টিকার মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ ছাড়াও দেশে আরো ছয়টি টিকার জরুরি অনুমোদন দিতে তোড়জোড় চলছে। টিকাগুলো অনুমোদন দিতে গতকাল বৃহস্পতিবার এক সভায় বিশদ আলোচনার পর সরকারকে সুপারিশ করেছে দেশে টিকা ব্যবহারের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ কমিটি ন্যাশনাল ইম্যুনাইজেশন টেকনিক্যাল গ্রুপ (নাইটেগ)। সরকারের পক্ষ থেকে যেকোনো সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল মহল থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা টিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন, রাশিয়ার স্পুিনক ভি, চীনের সাইনোফার্ম (বেইজিং) ও সাইনোভেক। এ ছাড়া আগেই ব্রিটেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল; ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে উৎপাদিত এই টিকার এক কোটি তিন লাখ ডোজ হাতে পেয়েছে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, এখন নাইটেগের ওই সুপারিশ সামনে রেখে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ওই টিকাগুলো অনুমোদনের পরবর্তী প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে। এ ক্ষেত্রে তিনটি টিকার জন্য আইনগত বিশেষ জরুরি সংশোধনের প্রয়োজন হবে বলেও জানান টিকা বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, আগামী রবি-সোমবারের মধ্যেই একাধিক কম্পানিকে দেওয়া হতে পারে টিকা নিয়ে আসার অনুমতি। সেই সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের দুটি টিকা দেশেই উৎপাদনের অগ্রগতিও মিলবে এই সপ্তাহের মধ্যে। এমনকি চীনের পাঁচ লাখ ডোজ উপহারের টিকা দেশে আসবে বলেও আসা করা হচ্ছে। পাশাপাশি নানা ধরনের জটিলতার মধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আরো কিছু টিকা দেশে আসবে বলেও আভাস মিলেছে। অন্যদিকে আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে বা মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের এক লাখ ডোজ টিকা দেশে এসে পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানা গেছে।
সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের নানামুখী ইতিবাচক তৎপরতায় অন্য কোনো দেশে না হলেও বাংলাদেশে আরো কিছু টিকা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা করছে ভারত। ওই সূত্রের তথ্যের সঙ্গে মিল রয়েছে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের বক্তব্যেরও। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সেরামে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে টিকার কারণে সম্পর্ক নষ্ট হবে না। শিগগিরই বাংলাদেশ যাতে টিকা পায় তা নিয়ে কাজ চলছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রায় প্রতিদিনই ভারতের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ চলছে; কখনো সরাসরি আবার কখনো বেক্সিমকোর মাধ্যমে। এ ছাড়া প্রতিশ্রুতির টিকা দ্রুত পেতে গতকাল কোভ্যাক্সের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। কোভ্যাক্স থেকে টিকা আসা শুরু হলে এবং তা যদি নিয়মিত আসতে থাকে, তবে এখন টিকার সংকট নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সেটি থাকবে না। বরং দেশের নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর বড় অংশই এ বছরের মধ্যে টিকা পেয়ে যাবে।
এদিকে রাশিয়া ও চীনের দুটি টিকা বাংলাদেশে উৎপাদনের ব্যাপারে মাঝে কিছুদিন কোনো অগ্রগতি না থাকলেও এখন আবার বিষয়টি দ্রুত এগোতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে রাশিয়া ও চীন থেকে যার যার টিকার অনুমতি দিতে আবেদন করেছে। ফলে এরই মধ্যে এই দুই দেশের সঙ্গে সরকার টিকাসংক্রান্ত চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করেছে। রাশিয়া শুধু টিকা উৎপাদনই নয়, তারা বাংলাদেশের যে কম্পানির সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে ওই কম্পানিকে প্রযুক্তিগত সহায়তাও দেবে। এ ছাড়া মডার্না ও জনসন অ্যান্ড জনসনের সঙ্গে দেশের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে সরকার। অনুমতির পরই দেশের ওই প্রতিষ্ঠান দুটি বা কমপক্ষে একটি কম্পানি পাঁচ থেকে ১০ লাখ ডোজ টিকা দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে এনে প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় প্রয়োগ শুরু করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ১২টি টিকা বিভিন্ন দেশে অনুমোদনের মাধ্যমে মানবদেহে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচটি টিকা রয়েছে চীনের (সিনোভ্যাক, ক্যানসিনো, সিনোফার্ম, সিনোফার্ম-উহান ও নোভাভেক্স), দুটি রাশিয়ার (গেমেলিয়া ও ভিক্টর), একটি যুক্তরাজ্য-সুইডেনের (অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা), তিনটি যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের (মডার্না, ফাইজার ও জনসন অ্যান্ড জনসন), ভারতের একটি (ভারত বায়োটেক); যার মধ্যে একটি তিন ডোজের, দুটি এক ডোজের এবং বাকিগুলো দুই ডোজের। এর মধ্যে কোনো কোনো টিকা একেক দেশের মানুষের মধ্যে একেক মাত্রায় কার্যকর হচ্ছে। বিশেষ করে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা আমেরিকায় ৭২ শতাংশ কার্যকর হলেও লাতিন আমেরিকায় তা কার্যকর ৬১ শতাংশ, আবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ৬৪ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশের ওষুধ নীতিমালা অনুসারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফডিএ কিংবা ইউরোপসহ সাতটি দেশের অনুমোদন না থাকায় রাশিয়া ও চীনের তিনটি টিকা দেশে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা রয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। এখন ওই টিকার অনুমোদনের জন্য বিধিমালায় জরুরি কিছু সংশোধনের প্রয়োজন।
তবে এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিধি-বিধানে যেটাই থাকবে, সবটাই মানুষের জন্য। ফলে এখন মহামারি মোকাবেলায় জরুরি অবস্থায় ওই বিধি সহজেই পাশ কাটানোর সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সব দেশই এখন পর্যন্ত সব কটি টিকাই জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছে। আমাদের এখানেও সেভাবেই অনুমোদন পেতেই পারে। অন্যদিকে রাশিয়া বা চীনের টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন না দিলেও নিষিদ্ধ করেনি। ফলে আমাদের দেশে এখন টিকার সংকট কাটাতে এগুলো ব্যবহার করাই যায়।’