ডেস্ক নিউজ
ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে ধানের উৎপাদন না কমিয়ে স্থানীয়ভাবে তেলজাতীয় ফসলের আবাদ চারগুণ বৃদ্ধি করার ৩ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন না কমিয়ে স্থানীয়ভাবে তেলজাতীয় ফসলের আবাদ তিনগুণ বৃদ্ধি করা হবে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ে ‘ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে কর্মপরিকল্পনা’ বিষয়ক বৈঠক শেষে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এসব তথ্য জানান।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশে ১০ লাখ টন তেল উৎপাদন করা হবে। যা দেশের চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ। এর ফলে তেল আমদানিতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য অনুাযায়ী-দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী ফসলের উৎপাদন হয় মাত্র তিন লাখ টন। যা চাহিদার শতকরা ১২ ভাগ। বাকি ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে তেল আমদানিতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় আর এ বছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক আরও বলেন, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ আমদানি করতে হয়। এ বছর দেশে ভোজ্যতেল নিয়ে সংকট চলছে। অনেক বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে তেল আমদানি করতে হচ্ছে। এতে একদিকে ভোক্তাদের কষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ পড়ছে।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে আমরা তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।
তিনি আরও বলেন, তেলজাতীয় ফসল উৎপাদনের মূল সমস্যা হলো ধানসহ অন্য সব ফসলের তুলনায় কম লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা চাষ করতে চান না। আমরা ধানের উৎপাদনও কমাতে চাই না। এজন্য, আগামী তিন বছরের মধ্যে স্থানীয়ভাবে ১০ লাখ টন তেল উৎপাদন করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যা চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। আমদানি নির্ভরতা অনেক কমিয়ে এনেছি। পেঁয়াজের মতো ভোজ্যতেলের উৎপাদনেও আমরা সফল হব।
ড. রাজ্জাক বলেন, কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে সরিষা, তিল, বাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ তেলজাতীয় ফসলের আবাদ তিনগুণ বৃদ্ধি করে বর্তমানের ৮ লাখ ৬০ হেক্টর জমি থেকে ২৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরে উন্নীত করা হবে। আর তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বর্তমানের ১২ লাখ টন থেকে ২৯ লাখ টনে এবং তেলের উৎপাদন বর্তমানের ৩ লাখ টন থেকে ১০ লাখ টনে উন্নীত করা হবে।
এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমটি হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা, বর্তমানে আবাদ করা টরি-৭, মাঘী, ডুপিসহ স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উচ্চফলনশীল সরিষার জাত বিনা-৪, ৯, বারি ১৪, ১৭ প্রভৃতি জাত ছড়িয়ে দেওয়া দ্বিতীয়তঃ অনাবাদি চরাঞ্চল, উপক‚লের লবণাক্ত, হাওড় ও পাহাড়ি অঞ্চলকে তেলজাতীয় ফসল চাষের আওতায় আনা। তৃতীয়ত, নতুন শস্যবিন্যাসে স্বল্প জীবনকালের ধানের চাষ করে রোপা আমন ও বোরোর মধ্যবর্তী সময়ে অতিরিক্ত ফসল হিসাবে সরিষার চাষ করা। এ বিন্যাসে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
সরিষার তেল, বাদাম তেল, তিলের তেল ও নারিকেল তেলের উপর ভর করে এক সময় ভোজ্য তেলের শতভাগ জোগানই দেশ থেকেই হত। গত পাঁচ দশক ধরে ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেল ও পাম সুপার তেল সেই জায়গা দখল করে নেয়।
কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলাম বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা দেশে উৎপাদন থেকে আসা বাদাম তেল, নারিকেল তেলসহ অন্যান্য তেল ব্যবহার করেই খাবার তৈরি করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই বাজার আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দখলে চলে যায়। কিন্তু দেখা গেছে, আমাদের দেশে উৎপাদিত তেলই বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। আমরা আবারও দেশে তেল বীজের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যেতে চাই।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, সরিষা লাভজনক হয় না বলে চাষিরা এটা উৎপাদনে যেতে চান না। সেজন্য ধানের উৎপাদন না কমিয়ে সরিষা চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কিছু ধানের জাত আবিষ্কার করেছে, যেগুলো ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে পেকে যায়। সাধারণ ধান পাকতে ১৪০ থেকে ১৬০ দিন প্রয়োজন হয়। যেসব প্রজাতির ধান কম সময়ে ফলন দেয় (স্বল্পকালীন) সেসব ক্ষেত্রে স্বল্পকালীন সরিষা চাষাবাদ করলে তা অতিরিক্ত ফসল হিসাবে বিবেচিত হয়। ধানটা কেটেই সরিষা বপণ করা যাবে। ৮০ থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে পেকে যাবে। ধানের উৎপাদন ঠিক রেখে সরিষা উৎপাদনের পর আবার বোরো ধান আবাদ শুরু করা যাবে। ফলে সরিষাটা একটা অতিরিক্ত ফসল হিসাবে পাচ্ছি। এর উৎপাদন খরচও হবে অনেক কম।”
২০ লাখ হেক্টর জমিতে স্বল্প সময়ে ফলন আসা আমন ধান চাষ হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যদি ৫ লাখ হেক্টর জমিতেও স্বল্পকালীন উচ্চফলনশীল সরিষা চাষ করতে পারি, তাহলে বিরাট পরিমান উৎপাদন বাড়াতে পারবে। সরিষার মাধ্যমে এক বিঘা জমি থেকে একজন কৃষক ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা অতিরিক্ত আয় করতে পারবে। এতে কৃষকের আয় বাড়বে, অতিরিক্ত সরিষার উৎপাদন হবে এবং তেলের আমদানি নির্ভরতা কমবে।