বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংগঠন অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামের সংগঠনটি এক সংবাদ সম্মেলন করে আগামী ৭ই নভেম্বর ঢাকাসহ দেশের জেলা-উপজেলায় প্রধান রাস্তায় দুই ঘন্টার অবস্থান এবং প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে।
তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ সুরক্ষা আইন করার দাবিও জানিয়েছেন।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশে আগেও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোন ঘটনার বিচার না হওয়ায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। সেজন্য তারা আলাদা সুরক্ষা আইনের দাবিকে সামনে এনেছেন।
তারা বলেছেন, ফ্রান্সে ইসলাম নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের ব্যাপারে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো যখন প্রতিবাদ করছে, সেই সুযোগ নিয়ে কোন গোষ্ঠী গুজব ছড়িয়ে ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার গুজবে কয়েকদিন ধরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হচ্ছে বলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ অভিযোগ করেছে।
এই সংগঠনের নেতারা বলেছেন, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে দলিত সম্প্রদায়ের একজন কলেজ ছাত্রীর ফেসবুক হ্যাক করে অন্য ধর্ম নিয়ে পোস্ট দেয়ার অভিযোগের তথ্য প্রমাণ তারা পুলিশকে দিয়েছেন। কিন্তু সেই ঘটনা নিয়ে সেখানে ঐ ছাত্রীর বাড়িতে ভাঙচুর করা হয় এবং পুলিশ তাকেই গ্রেপ্তার করেছে।
তারা আরও অভিযোগ করেছেন, ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন ছাত্রীর বিরুদ্ধেও একইভাবে ‘ধর্ম অবমাননার’ গুজব ছড়ানো হয় এবং কয়েকদিন ধরে সেই ছাত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, গুজব ছড়িয়ে একদিকে হামলা করা হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্তদেরকেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
“আমাদের কাছে স্পষ্ট মনে হচ্ছে, প্যারিসের ঘটনার অজুহাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় হামলার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে আমরা দু’টো বড় ঘটনা দেখলাম, একটা হলো দিনাজপুরের পার্বতীপুরে এবং আরেকটা কুমিল্লার মুরাদনগরে, যেখানে সংখ্যালঘুপল্লী আক্রান্ত হয়েছে।”
মি: দাশগুপ্ত বলেছেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়- তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং একটি কলেজের ছয় জন ছাত্রছাত্রীর ছাত্রত্ব বাতিলের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে হুমকি দেয়া হচ্ছে। তারা সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের ফেসবুক হ্যাক করে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে তাদেরকেই ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।”
কয়েকদিন আগে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহীদুন্নবী জুয়েল নামের একজন ব্যক্তিকে হত্যার পর তার মৃতদেজ আগুন দিয়ে পোড়ানোর ঘটনা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
এরপর কুমিল্লার মুরাদনগরে কয়েকটি হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, এমন পরিস্থিতি সংখ্যালঘুদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সেজন্য তারা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন চাইছেন।
“কতগুলো ঘটনা হয়েছে, কোন ঘটনার বিচার হয় নাই। অতীতে মামলাও নেয়া হতো না। এখন এই সরকারের আমলে মামলা নেয়া হলেও বিচার হয় না। সাক্ষীরা ভয়ে যায় না। এই অবস্থায় আমরা মনে করি, বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। এজন্য আমরা একটা বিশেষ সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের দাবি তুলেছিলাম।”
তিনি বলেছেন, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে আমাদের দাবি সমর্থন করেছিল। তারা সংখ্যালঘুদের জন্য সুরক্ষা আইন করার কথা বললেও ক্ষমতায় এসে কোন উদ্যোগই নেয়নি।”
তিনি উল্লেখ করেছেন, সংবিধানে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ফলে আলাদা কোন আইন করা হলে, তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না বলে তারা মনে করেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইনের বিষয় তারা খতিয়ে দেখবেন। তবে কোন মামলার বিচার হয় না-সেটা তিনি মানতে রাজি নন।
“এই সরকার, জনগণ যখনই কিছু যুক্তিসংগত কথা বলে, সেটার ব্যাপারে তারা বিবেচনা করে। তো আমার কথা হচ্ছে, এটার ব্যাপারে তারা প্রশ্ন তুলেছেন,আমি তা খতিয়ে দেখবো। এবং বিবেচনার যোগ্য হলে নিশ্চয়ই তা বিবেচনা করা হবে।”
“বিচার হয় না বলে ওনার যা বলেছেন, কোনটার বিচার হয়নি বা থেমে আছে- সেগুলো বললে আমি তাও খতিয়ে দেখবো। কয়েক বছর আগের রামু এবং নাসিরনগরের ঘটনার বিচার কার্যক্রম এগুচ্ছে। কিন্তু ঢালাওভাবে বলা যে বিচার হচ্ছে না-একথাটা আমি মেনে নিতে পারছি না।”
মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্টের সারা হোসেন বলেছেন, ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে কয়েকদিন ধরে যে সব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে আইনী ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা