ডেস্ক নিউজ
দেশে প্রথমবারের মতো সিআইপি সমমানের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন মাঠের কৃষকরা। কৃষি মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ১৩ ব্যক্তিকে এআইপি-২০২০ সম্মাননা দিয়েছে। জাতীয় স্বীকৃতি পাওয়ায় অভিভূত ও আবেগাপস্নুত হয়েছেন সম্মাননা প্রাপ্ত কৃষকগণ। মাটির সঙ্গে যাদের পথচলা তারা জীবনে প্রথম ঢাকায় আলো ঝলমলে মঞ্চে জাতীয় স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা পেয়ে আবেগে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
বুধবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কৃষকদের এগ্রিকালচারালি ইমপর্ট্যান্ট পারসন (এআইপি) সম্মাননা প্রদান করা হয়। কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ সম্মাননা প্রদান করেন। এ সময় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সম্মাননা প্রাপ্ত কৃষকগণ পেয়েছেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রশংসাপত্র, এক বছর মেয়াদে বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রবেশের জন্য পাস, বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে নাগরিক সংবর্ধনায় আমন্ত্রণ; বিমান, রেল, সড়ক ও জলপথে ভ্রমণকালীন সরকার পরিচালিত গণপরিবহণে আসন সংরক্ষণে অগ্রাধিকার। এছাড়া ব্যবসা-দাপ্তরিক কাজে তাদের বিদেশে ভ্রমণের জন্য ভিসা প্রাপ্তির নিমিত্তে মন্ত্রণালয়ের লেটার অব ইন্ট্রোডাকশন ইসু্য করবে। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের কেবিন সুবিধা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবেন এবং বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারে সুবিধা পাবেন।
বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কারে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বিভাগে এআইপি সম্মাননা প্রাপ্ত মোছা. নুরুন্নাহার বেগম অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘কৃষিকাজ করে এত বড় সম্মান পাওয়া যাবে আমরা কল্পনাও করিনি। আমাকে কেউ ১০ লাখ টাকা দিক, আমি তা চাই না। কিন্তু এ সম্মাননা অনেক বড় পাওয়া। তিনি বলেন, মাটিকে ঘুষ দেওয়া লাগে না। মাটির সঙ্গে পরিশ্রম করলে, মাটি আমাদের সঙ্গে কথা বলে। আমাদের মতো কৃষককে এত বড় সম্মাননা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।’
ঈশ্বরদীর জয়নগর এলাকার সাড়ে ৩২ হেক্টর জমির ওপর ‘নুরুন্নাহার কৃষি খামারে’ যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। তার খামারে ৩ হাজার ২৫৩ জন কর্মী কাজ করে। দুই কোটি ৩৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বর্তমানে তিনি বছরে ৯০ লাখ ৪২ হাজার টাকার বেশি আয় করছেন।
এআইপি সম্মাননা পেয়েছেন কুমিলস্নার নাঙ্গলকোর্টের বিছমিলস্নাহ মৎস্য বীজ উৎপাদন কেন্দ্র ও খামারের মালিক মো. সামছুদ্দিন কালু। অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘মাছের ব্যবসা শুরু করার সময় চৌধুরী বংশের এক বন্ধু মানসম্মানের ভয়ে ব্যবসায় আসেনি। আর আজকে আমার মতো একজন মাইচ্ছ বা চাড়ালকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এআইপি সম্মানে ভূষিত করেছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। এ দেখে পুরো জাতি জাগ্রত হবে।’ বর্তমানে তার ৪৫ হেক্টরের মাছের খামার রয়েছে।
এ সময় কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এআইপি সম্মাননা দেওয়ায় কৃষকদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে। সম্মাননা প্রাপ্ত কৃষকগণ সিআইপি সমমানের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন। দেশের কৃষির সাফল্যের অন্যতম কারিগর দেশের কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, উৎপাদনকারী, খামারিসহ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্তদেরকে প্রতি বছর সম্মাননা জানানোর জন্য এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। কৃষকদের সম্মান জানানোর জন্য এটি একটি নতুন উদাহরণ। এআইপি সম্মাননা প্রবর্তন কৃষি খাতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এর ফলে কৃষি পেশার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, এআইপি সম্মাননা দিয়ে আমরা কৃষকসহ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্তদের সম্মানিত করেছি, নিজেকে সম্মানিত করেছি এবং সেইসঙ্গে জাতিকেও সম্মানিত করেছি। আগামী দিনের কৃষিকে আমরা বাণিজ্যিক ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে উন্নীত করতে চাই। কৃষিতে শিক্ষিত, মেধাবী ও সৃজনশীল তরুণদের আকৃষ্ট করতে চাই। এ সম্মাননা এক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
এআইপি সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার। সভাপতিত্ব করেন কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার।
উলেস্নখ্য, দেশের কৃষির সাফল্যের অন্যতম কারিগর কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, উৎপাদনকারী, খামারিসহ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্তদেরকে প্রতি বছর সম্মাননা জানাতে ও তাদেরকে উৎসাহিত করতে কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সম্মাননা প্রদানের জন্য ২০১৯ সালে এআইপি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। তার আলোকে বুধবার প্রথমবার ২০২০ সালের সম্মাননা প্রদান করা হয়। এবার ১৩ জনকে সম্মাননা দেওয়া হলেও এআইপি নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর মোট পাঁচটি বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৫ জনকে সম্মাননা প্রদান করা হবে। এর মধ্যে কৃষি উদ্ভাবন বিভাগে (জাত-প্রযুক্তি) সর্বোচ্চ ১০ জন, কৃষি উৎপাদন ও বাণিজ্যিক খামার স্থাপন ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বিভাগে সর্বোচ্চ ১৫ জন, রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদন বিভাগে সর্বোচ্চ ১০ জন, স্বীকৃত বা সরকার কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত কৃষি সংগঠন বিভাগে সর্বোচ্চ পাঁচজন এবং বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কারে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বিভাগে সর্বোচ্চ পাঁচজন।
বুধবার কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সম্মাননাপ্রাপ্ত ১৩ জন হলেন- কৃষি উদ্ভাবন বিভাগে (জাত-প্রযুক্তি) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর লুৎফুল হাসান (বাউধান-৩ এর জাত উদ্ভাবন), এ আর মালিক সিডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউস সোপান মালিক (২টি বীজ আলুসহ মোট ১০টি সবজির জাত উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণ), ফিউচার অর্গানিক ফার্মের সৈয়দ আব্দুল মতিন (মেহগনি ফলের বীজ থেকে তেল তৈরি, যা জৈব বালাইনাশক প্রস্তুত) আলীম ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেডের আলীমুছ ছাদাত চৌধুরী (আলীম পাওয়ার ট্রিলার উদ্ভাবন)।
কৃষি উৎপাদন-বাণিজ্যিক খামার স্থাপন ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বিভাগে ছয়জন। তারা হলেন- মো. সেলিম রেজা, দৃষ্টান্ত এগ্রো ফার্ম অ্যান্ড নার্সারি, ডাল সড়ক, নাটোর সদর, নাটোর। মো. মেহেদী আহসান উলস্নাহ চৌধুরী, চামেশ্বরী, চৌধুরীহাট, ঠাকুরগাঁও। মো. মাহফুজুর রহমান, এশা ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচার ফার্ম, ঝালকাঠি সদর, ঝালকাঠি। মো. বদরুল হায়দার বেপারী, প্রোপ্রাইটার, জাগো কেঁচো সার উৎপাদন খামার, চৌঠাইমহল, নাজিরপুর, পিরোজপুর। মো. শাহবাজ হোসেন খান, নুর জাহান গার্ডেন, শৌলা কালাইয়া, বাউফল, পটুয়াখালী। মো. সামছুদ্দিন (কালু), বিছমিলস্নাহ মৎস্য বীজ উৎপাদন কেন্দ্র ও খামার, নাঙ্গলকোট রেলস্টেশন সংলগ্ন, নাঙ্গলকোট, কুমিলস্না। স্বীকৃত বা সরকার কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত কৃষি সংগঠন বিভাগে জাহাঙ্গীর আলম শাহ, শাহ, কৃষি তথ্য পাঠাগার ও জাদুঘর কালীগ্রাম, মান্দা, নওগাঁ। বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কারে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বিভাগে নির্বাচিত হয়েছেন দুজন। তারা হলেন- মোছা. নুরুন্নাহার বেগম, নুরুন্নাহার কৃষি খামার, ঈশ্বরদী, পাবনা এবং মো. শাহজাহান আলী বাদশা, মা-মণি কৃষি খামার, ঈশ্বরদী, পাবনা।