ডেস্ক নিউজ
তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিচার বিভাগ। সেই বদলে যাওয়ার ঢেউ লেগেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও। জুডিশিয়াল পোর্টাল, অনলাইন কজলিস্ট, ডিজিটাল ড্রাশবোর্ডের পর এবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন মামলার নথি ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এই ডিজিটালাইজেশন প্রকল্পের অধীনে ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অথার্ত্ গত ২০ বছরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন প্রায় ৫ লাখ মামলার নথি ডিজিটালাইজড হয়ে আর্কাইভে যুক্ত হবে। ইতিমধ্যে ১৫ হাজার মামলার নথি ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তর করা হয়েছে। বাকি মামলার নথি ডিজিটালাইজেশনের কাজটি প্রক্রিয়াধীন। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডিজিটাল আর্কাইভিং’।
বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টে লাখ লাখ মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার ফাইল (নথি) সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোতে স্তূপাকারে রাখা হয়েছে। জায়গার অভাবে গাদাগাদি করে ফাইল রাখায় তা অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। যথাসময়ে আদালতে ফাইল না পৌঁছায় শুনানি বিলম্বিত হয়। হতাশ হয় বিচারপ্রার্থীরা। ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ের ফলে নথি পাওয়ার ঝামেলা দূর হওয়ার পাশাপাশি আদালতে কাগুজে নথির প্রয়োজন ফুরাবে। এমনকি ভাচুর্য়াল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে মামলার নথি আনা-নেওয়ার ঝামেলা দূর হবে। মামলার নম্বর ধরে সার্চ দিলেই পুরো মামলার নথি কম্পিউটার বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে। ফলে যে কোনো স্হানে থেকে বিচারক ও আইনজীবীরা মামলা পরিচালনা করতে পারবেন।
সুপ্রিম কোর্ট হতে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১১ হাজার ৮১৬টি মামলা বিচারাধীন ছিল। ২০ বছর পর সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ২২৫টিতে। আর হাইকোর্টে ২০ বছর আগে মামলা বিচারাধীন ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১৭৮টি। সেই সংখ্যা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৬৩টি। এখন ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ের অধীনে সুপ্রিম কোর্টে গত ২০ বছরে বিচারাধীন সব ধরনের মামলার লাখ লাখ নথি ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে।
যেভাবে ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে : সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনে ‘স্ক্যানিং অ্যান্ড ডিজিটাইজেশন অব কেস ফাইলস’ এর আওতায় চলছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। সুপ্রিম কোর্টকে এই পুরো কাজে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে সরকারের আইসিটি বিভাগের অধীনে বাংলাদেশে কম্পিউটার কাউন্সিল। অ্যানেক্স ভবনের চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায়, বেসরকারি সাফরন করপোরেশনের প্রায় ৩০০ কর্মী ছয়টি ধাপে এই ডিজিটালাইজেশনের কাজ করছেন। প্রথমত সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন শাখা থেকে পাঠানো ফাইলগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠা পরিষ্কার করা হচ্ছে। পরিষ্কার শেষে সেগুলো গ্রহণ করছেন অন্য কর্মীরা। ফাইল গ্রহণের পর মামলার নম্বর এবং কোন ধরনের মামলা সাল অনুযায়ী সেগুলো বারকোড দিয়ে এন্ট্রি করা হচ্ছে। এরপর মামলার ফাইল পাঠানো হচ্ছে স্ক্যানিং বিভাগের কর্মীদের কাছে। আধুনিক মেশিনে সেগুলো স্ক্যানিং করার পর সেগুলোর কোয়ালিটি কনট্রোল করা হচ্ছে। এরপর পুনরায় মামলার ফাইলটি বাইন্ডিং করে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে ডিজিটাল আর্কাইভিং এবং ই-ফাইলিং ব্যবস্হাপনার উদ্বোধন করা হয়। ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, করোনা মহামারিকালে যে প্রযুক্তিনির্ভর বিচার ব্যবস্হা চালু হয়েছে তা ধারাবাহিক হলে আগামী ২/৩ বছরে বিপ্লব ঘটে যাবে। মামলা জট থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ভাচুর্য়াল কোর্টের বিকল্প নাই। এজন্য বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষিত হতে হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল আর্কাইভিং সিস্টেমের মাধ্যমে ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সব মামলার নথি সংরক্ষণের যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে তা পর্যায়ক্রমে নথির ডিজিটাল আর্কাইভিং ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এর মাধ্যমে আদালতের নথি ব্যবস্হাপনার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে নথিপত্র সংরক্ষিত থাকবে বিধায় এর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অ্যানালগ পদ্ধতিতে মামলার নথি বা সংশ্লিষ্ট আদেশ খুঁজে বের করার ঝামেলা ও সময় হ্রাস পাবে এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ডিজিটাল হওয়ায় আদালতের ভৌত অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তাও বহুলাংশে কমে যাবে। সুপ্রিম কোর্টে চালু ই-ফাইলিং পদ্ধতি হাইকোর্টের কোম্পানি ও অ্যাডমিরালটি বিষয়ক মামলা, আপিল, দরখাস্ত ই-ফাইলিং পদ্ধতিতে দায়ের করছেন আইনজীবীরা। গত বৃহস্পতিবার থেকে এই প্রক্রিয়ায় মামলা দায়ের করছেন আইনজীবীরা। প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। সেই অনুযায়ী ই-ফাইলিং পদ্ধতিতে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। করোনাকালে সচল ছিল ভার্চুয়াল কোর্ট করোনাকালে দেশের জনগণকে বিচার পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে ভাচুর্য়াল কোর্ট। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এই কোর্ট। যেখানে বিচারক ও আইনজীবীরা বাসায় বসে মামলা পরিচালনায় অংশ নিয়েছেন। অনেক আইনজীবী দেশের বাইরে থেকেও মামলা পরিচালনা করেছেন। এই কোর্ট থেকে করোনাকালে দেড়লাখ আসামি বিভিন্ন মামলায় জামিন পেয়েছেন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের সকল বেঞ্চে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ভাচুর্য়ালি। যার ফলে করোনা মহামারিতেও দেশের বিচার ব্যবস্হা সচল ছিল।