ডেস্ক নিউজ
রোমানিয়ার বুখারেস্ট থেকে বুধবার দুপুরে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ
হাদিসুরের পরিবারের আহাজারি
দ্রæত তার লাশ ফিরিয়ে আনার আশ্বাস
শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকা পড়া বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ২৮ নাবিক-ক্রুকে। তারা রোমানিয়ার বুখারেস্ট থেকে টার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে বুধবার দুপুর ১২টা ১ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। তাদের আগমনে বিমানবন্দরে বিপুলসংখ্যক গণমাধ্যমকর্মী ও স্বজনদের উপস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত আকারে জানানো হয় কোন পরিস্থিতিতে তাদের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে এ সময় সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে রকেট হামলায় নিহত হাদিসুর রহমানের ছোট ভাইয়ের বুকফাটা আর্তনাদ আহাজারিতে। শত শত লোকের সামনেই তিনি বিমানবন্দরের ভিআইপি গেটে মেঝে গড়িয়ে বুক চাপড়িয়ে সবাইকে যেন শোকার্ত করে তোলেন। তার সামনেই এক সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (পূর্ব-ইউরোপ) শিকদার বদিউজ্জামান আশ্বাস দেন, ‘হাদিসুর রহমানের মরদেহ এখনও ইউক্রেনে রয়েছে। যত দ্রæত সম্ভব দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবিলম্বে আনা হবে।
বিমানবন্দরে সরজমিনে দেখা যায়, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সকাল দশটা থেকেই বিপুলসংখ্যক গণমাধ্যমকর্মী সেখানে হাজির হতে থাকেন। সিডিউল মতো ফ্লাইটটি অবতরণ করার পরই নাবিকদের ভিআইপি গেট দিয়ে বের করে নিয়ে আসা হয় লাউঞ্জে। এখানে তারা কিছুক্ষণ থাকার পর চলে যান লাগেজ সংগ্রহ করতে ৩নং বেল্টে। সেখান থেকে সবাই একযোগে নিজ নিজ লাগেজ সংগ্রহ করে আবারও লাউঞ্জে বসে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেন। বিমানবন্দরে সবাই লাগেজ হাতে নিয়ে লাউঞ্জে ফেরার সময় তাদের দেখা গেছে বিষাদময়। একদিকে সহকর্মী হারানোর বেদনায় কাতর, অন্যদিকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশে ফেরার সৌভাগ্য হওয়ার আনন্দে তারা ছিলেন অনেকটাই বিস্মিত ও হতবাক। তাদের কাছে কিছু জানতে চাইলে শুধু বলেছেন, এখন কিছু বলার মতো পরিস্থিতি নেই। আগে ঘরে ফিরি। পরে সব জানানো যাবে। দেশে ফিরতে পেরেছি এটাই বড়।
এ সময় তাদের বসিয়ে রেখে ভিআইপি গেটে অপেক্ষমাণ শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীর সামনে গিয়ে হাজির হন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (পূর্ব-ইউরোপ) শিকদার বদিউজ্জামান, ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন জি এম নুর ই আলম ও শিপিং কর্পোরেমানের ক্যাপ্টেন আমির মোঃ আবু সুফিয়ান।
একই সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনে এখনও অনেক বড় বড় দেশের ক্রুরা আটকা আছেন। তারা এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। বাংলাদেশ খুব ছোট একটা দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আমাদের ক‚টনীতিকরা অনেক পরিশ্রম ও চেষ্টা করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক শিকদার বদিউজ্জামান উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ও পোল্যান্ড, রোমানিয়ায়, অস্ট্রিয়ার দূতাবাস কঠোর পরিশ্রম করেন। আমরা এত দ্রত দেশে ফিরতে পারব কিনা তা ছিল আমাদের জন্য অকল্পনীয়।
আমরা সৌভাগ্যবান- ফেরাটা অকল্পনীয় ছিল ॥ ওই জাহাজের মাস্টার জি এম নূরে আলম দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমরা সকলেই আনন্দিত সুস্থভাবে দেশ ফিরতে পেরেছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আসলেই আমরা সৌভাগ্যবান। ওরকম পরিস্থিতিতে যে কোন কিছু ঘটতে পারত। চোখের সামনে তো দেখলাম কিভাবে হাদিস চলে গেল।
সেই ভিড়ের মধ্যেই নাবিকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন জাহাজের মাস্টার নূর ই আলম। তিনি বলেন, দেশে সুস্থভাবে ফিরতে পেরে অনেক আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট সবার তৎপরতায় নিরাপদে এবং দ্রæততম সময়ে দেশে ফিরতে পেরেছি- আমাদের পরিবার অপেক্ষায় ছিলেন, সবার চেষ্টায় ফিরতে পেরেছি এত অল্প সময়ের মধ্যে। নূর ই আলম বলেন, আমরা আতঙ্কিত ছিলাম। আমাদের সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা এখানে সুস্থভাবে আসতে পেরেছি, এটাই বড় কথা। তবে আমরা জার্নি করায় খুব ক্লান্ত।
ওই জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার পর বিএসসি, নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সব সময় যোগাযোগ রাখা হয়েছিল জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নূর ই আলম। তাদের বের করে আনার জন্য পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং রোমানিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস কর্মীরা যে পরিশ্রম করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন-সাধারণত আমার সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারও কথা হয় না, কিন্তু হামলার পর বিভিন্ন সময়ে আমাদের সার্বিক অবস্থা জানতে, আমরা কে কেমন আছি এসব জানতে… আমার সঙ্গে সরকারের কর্মকর্তারা কথা বলেছেন, সাহস দিয়েছেন। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সব কাজ হয়েছে, সবার প্রতি আমি আসলেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, এভাবে ফিরতে পারব ভাবি নাই।
এখনও ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের চ্যানেলে আটকে থাকা বাংলার সমৃদ্ধির মাস্টারের ভাষায়, ‘ফিরে আসাটা ছিল অকল্পনীয়। কারণ অনেক বড় বড় দেশ আছে যাদের নাগরিক এখনও দেশে ফিরতে পারেনি। আমাদের ছোট দেশ, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ডিপ্লোম্যাটদের সহযোগিতায় এটি সম্ভব হয়েছে।
নিজেরা ফিরতে পারলেও সহকর্মী হাদিসুর রহমানের লাশ ইউক্রেনেই রেখে আসতে হয়েছে নূর ই আলমদের। সেজন্য কষ্ট প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।
তিন মিশনের যৌথ প্রচেষ্টায় আনা হবে মরদেহ ॥ বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ দ্রæত দেশে ফেরাতে তিনটি মিশন একসঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক শিকদার বদিউজ্জামান। তিনি বলেছেন, হাদিসুর রহমানের মরদেহ এখনও ইউক্রেনে রয়েছে। যত দ্রæত সম্ভব আমরা তার মরদেহ দেশে ফেরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে যেভাবে ফেরা ॥ ‘আসলে আমরা সবাই মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এটি নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়া। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমরা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি।
এভাবেই দেশে ফেরার অনুভ‚তি ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রামের রাকিব। তিনি এক দুঃসহ অভিজ্ঞতার সঙ্গেই তুলনা করেছেন ইউক্রেন থেকে ফেরার অভিযাত্রাকে। তার মতে- ‘তাদের মতো ভাগ্য সহায় হয়নি সহকর্মী নাবিক হাদিসুর রহমানের। ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর প্রাণ হারান। তারপর টানা ২১ ঘণ্টা পর জাহাজটি থেকে নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়। দ্রæততম সময়েই তারা আশ্রয় পান দেশটির একটি বাঙ্কারে। দুদিন পর মলদোভা হয়ে রোমানিয়া পৌঁছান তারা। বুধবার রাতে একটি বিশেষ ফ্লাইটে বাংলাদেশের উদ্দেশে বুখারেস্ট ত্যাগ করেন টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে।
হাদিসুরের ভাইয়ের আহাজারি ॥ দুর্ভাগা জাহাজটি যেন শুধু হাদিসুরের জন্যই অভিশপ্ত হয়ে ওঠেছিল। কেউ প্রাণ হারায়নি তাকে ছাড়া। সবাই ফিরে এসেছে মায়ের কোলে। বাকি রয়েছে শুধু হাদিসুর রহমান। তার মরদেহটিও আনা হয়নি। হাদিস না ফিরলেও তার সহকর্মীদের মুখে কিছু শোনার জন্য বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন তার শোকার্ত ভাই গোলম মাওলা প্রিন্স। সেখানেই তখন বিপুলসংখ্যক গণমাধ্যমকর্মীরা তাকে পেয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতেই ঢুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।
আজ রোমানিয়া নেয়া হবে হাদিসুরের মরদেহ ॥ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় নিহত এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মাদ হাদিসুর রহমানের মরদেহ ইউক্রেন থেকে রোমানিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খবর অনলাইনের।
মলদোভা হয়ে হাদিসুরের মরদেহ রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে নেয়া হবে বলে বুধবার রাত সোয়া ১১টায় বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন বিএমএমওএ সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মোঃ সাখাওয়াত হোসাইন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।