ডেস্ক নিউজ
শাপলা খাতুনঃ
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, দিনটি বাঙালী জাতির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন কারণ এই দিনেই ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মাহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাঙালী জাতির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। বাবা-মা আদর করে তাঁকে ‘খোকা’ বলেই ডাকতেন। এলাকার মানুষ ভালোবেসে ডাকতেন ‘মিয়া ভাই’ । ছ্টো বেলা থেকেই তিনি ছিলেন পরোপকারী, দানশীল , প্রতিবাদী ও বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তিনি কখনো পিছুপা হতেন না। রাজনীতির সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই স্কুল জীবন থেকেই। ১৯৩৮ সালে মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেনীতে অধ্যয়নকালে ব্রিটিশ শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আন্দোলনের করার শাস্তি হিসেবে কিশোর বয়সেই তাঁকে যেতে হয়েছিল জেলে। ৭ দিন কারাবরণ করার পর তিনি মুক্তি পান। এটাই ছিল তাঁর জীবনে প্রথম কারাবরণ। রাজনীতির এ কবি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মোট ৪৬৮২ দিন কারাবরণ করেছেন। তবে কারাগারে তাঁকে বন্দী করে রাখা গেলেও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে রুখতে পারেনি কেউ এমনিই দৃঢ় ছিল তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা।
১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪১-১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। এ সময় তিনি ইসলামীয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৩ সনে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে বেঙ্গল মুসলীম লীগের হয়ে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি,এ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর বৃটিশ উপনিবেশবাদী শাসনের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়নমূলক শাসন শুরু হয় যার প্রথম প্রকাশই ছিল ভাষার উপর আঘাত। ফলে ১৯৪৮ সালেই ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব শুরু হয়ে যায়। ১১ মার্চ ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষার দাবীতে ধর্মঘট পালিত হয় যার রুপরেখা তৈরী করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ কারণে তিনি রাজপথেই গ্রেফতার হন। তবে ছাত্র সমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৪৯ সালে তিনি আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আন্দোলন পরিচালনা করার দায়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাঁচ জনকে বহিস্কার করেন। উল্লেখ, বহিস্কারের ৬১ বছর পর ২০১০ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার হৃত ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য অনকে কিছুই হারিয়েছেন কিন্তু তিনি রাজনীতি থেকে কখনো সরে যাননি। ২৩ জুন ১৯৪৯ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। উল্লেখ, এ সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন। ৯ জুলাই ১৯৫৩ তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সেক্রেটারী জেনারেল নিযুক্ত হন।
১০ মার্চ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি গোপালগঞ্জ আসনে মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ১৯৫৪ খিস্ট্রাব্দের ১৫ মে তিনি কৃষি ও বন মন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং ১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৬৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৫ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬৬ লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনে তিনি বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ খ্যাত ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবী পেশ করেন। যার উদ্দেশ্যই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন লাভ। এ ৬ দফা দাবীর জনপ্রিয়তা এতবেশি ছিল যে পাকিস্তান সরকার ভয় পেয়ে যান এবং তার রাজনৈতিক কার্যক্রম রুদ্ধ করার জন্য ১৯৬৮ সালে “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য ” শিরোনামে মামলা দায়ের করেন। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। জনআন্দোরনের মুখে পাকিস্তান সরকার আবারও তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য এক বিশাল গণ-সম্বোধনায় আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানেই ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধু যে একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন বুকে লালন করছিলেন তার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে আয়োজিত এ জনসভায়। তিনি এ জনসভাতেই পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ করেন বাংলাদেশ। ১৯৭০ সারের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নানা টালবাহানা শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখনই বুঝে গিয়েছিলেন যে সংগ্রাম ছাড়া অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পার্লামেন্টারি পার্টিগুলোর নেতাদের সঙ্গে এক গোল টেবিল বৈঠকের আহ্বান করলে শেখ মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন। সেদিন বিকেলে ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। এ সভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। এ সভাতেই বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক ’ বলে আখ্যা দেন ছাত্রলীগ নেতা আ.স.ম আব্দুর রব এবং জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে। বঙ্গবন্ধু এ সভায় উপস্থিত হন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। এ জনসভায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন এবং প্রদান করেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ-“ এবারের সংগ্রাম আমাদেও মুক্তিার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধিনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর এ সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার জনগণ শত্রু সেনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্তি দেন, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু সদ্য জন্ম নেওয়া দেশ গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি গণপরিষদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এ সংবিধান কার্যকর হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের ফলেই আমরা পেয়েছি একটা স্বাধীন ভূখন্ড, একটা নতুন পতাকা, একটা সংবিধান। তাঁর জন্ম না হলে হয়তো আমরা পেতাম না স্বাধীনতার স্বাদ।
লেখকঃ এম.ফিল গবেষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।