‘শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও’- হাওরাঞ্চলের বিখ্যাত প্রবাদ। অর্থাৎ বর্ষাকালে নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না হাওরবাসীর। বিভিন্ন দিক থেকেই তারা ছিল অবহেলিত। উজানের মানুষ হাওরবাসীকে অবজ্ঞা করে ডাকত ‘ভাইট্টা গাবর’। এমনটিই ছিল হাওরাঞ্চলের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য।
এখন আর সে অবস্থা নেই। বদলে গেছে হাওরের দৃশ্যপট। উন্নয়নের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। অল ওয়েদার সড়ক নির্মিত হওয়ায় হাওরাঞ্চলের সেই চিরচেনা বৈশিষ্ট্য পাল্টে গেছে। ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম- এ তিন উপজেলাকে একই সুতায় বেঁধে দিয়েছে এ সড়কটি। দিগন্তবিস্তৃত হাওর এমনিতেই ছিল সৌন্দর্যের আধার। তার ওপর নির্মিত সড়কটি যেন হাওরের সৌন্দর্যের তিলক। অপরূপ হাওরের রূপে গুণে এখন মুগ্ধ সবাই। আর সে কারণেই হাওরবাসী একে তাদের ‘স্বপ্নের সড়ক’ নামে অভিহিত করছেন। কেউ কেউ সড়কটিকে ‘হাওরের বিস্ময়’ বলেও মন্তব্য করেন।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সড়কটি উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে কৃষির পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেরও অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো হাওরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কিশোরগঞ্জের পুব প্রান্তে বিস্তীর্ণ হাওর নিয়ে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার অবস্থান। হাওরে সড়ক যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে এ তিন উপজেলার জনগণ অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতো। হাওরবাসীর কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অভিপ্রায়ে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়। কিশোরগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অল ওয়েদার সড়কটি প্রায় ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮৭৪ কোটি টাকা। এ সড়কটিতে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন তিনটি পিসি গার্ডার ব্রিজ ও ১১টি আরসিসি ব্রিজ। ২০১৬ সালের শেষের দিকে সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় এ বছরের জুনে।
নিকট অতীতেও হাওরাঞ্চল ছিল অবহেলিত। ভাঙন ছিল হাওরবাসীর দুঃখ। আফাল ও ঢেউয়ের ভাঙনে অনেক গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে ফসলের বাজারজাত ও ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত ছিল হাওরবাসী। ফলে একটিমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল হাওরবাসী উদ্বৃত্ত ফসল ফলিয়েও নিজেরা দুঃখকষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছে। শুধু তাই নয়, বিশাল হাওর মাছের জোগান দিয়ে আসছে জেলাবাসীকে। যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে নিজেদের উৎপাদিত ও আহরিত মাছ সহজে বাজারজাত করতে না পারায় কম মূল্যে মহাজনদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হতো তারা। এ সড়কটি নির্মিত হওয়ায় তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
ভাঙনকবলিত গ্রামগুলোতে তৈরি করা হয়েছে প্রতিরক্ষা দেয়াল। ইটনা উপজেলার পশ্চিম গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একই সংসদীয় আসনের তিনটি উপজেলা এত দিন বিচ্ছিন্ন ছিল। কোথায় কখন কী হতো সহজে জানতে পারতাম না। এ সড়কটি আমাদের একই সুতায় গেঁথে দিয়েছে।’ কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, ‘সড়কটি নির্মিত হওয়ায় হাওরাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। যে হাওরাঞ্চল ছিল অবহেলিত, তার সৌন্দর্যে এখন সবাই মুগ্ধ।’