মেহেদী হাসান পলাশ:
বিশ্ব আদিবাসী দিবস উৎযাপনের দুইদিন আগে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার পরিহারের জন্য নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়।
তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বর্তমানে দেশে আদিবাসীদের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও বিভিন্ন সময় বিশেষ করে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বারবার ব্যবহার হয়ে থাকে।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাস রত ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীকে উপজাতি বা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে উল্লেখ করে তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা ও টকশোতে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার পরিহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
‘এ সকল আলোচনা ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার পরিহারের জন্য পূর্বেই সচেতন থাকতে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৮ জানুয়ারী ২০১০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারীকৃত ‘উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার অপতৎপরতা প্রসঙ্গে’ শিরোনামের গোপনীয় প্রতিবেদনে (স্মারক: পাচবিম (সম-২)২৯/২০১০/২৫, তারিখ: ২৮/১/২০১০) বলা হয়েছে: “বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন, এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুৃক্তিতে উপজাতীয় সম্পদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাদেরকে কোথাও ‘আদিবাসী’ হিসাবে অভিহিত করা হয়নি। তথাপি কতিপয় নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, এমনকি সাংবাদিকেরাও ইদানিং উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ না বলে ‘আদিবাসী’ হিসাবে অভিহিত করতে দেখা যাচ্ছে। এতদ বিষয়ে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রসমূহ এসকল ব্যাক্তিবর্গের সাহায্যে তাদের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়তায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ উপজাতীয় সম্প্রদায় এখন নিজ নিজ ধর্ম সংস্কৃতিতে অবস্থান না করে তাদের অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গেছে। বাংলাদেশীয় উপজাতীয়দেরকে ‘আদিবাসী’ উল্লেখ না করার বিষয়ে ইতোপূর্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে সে নির্দেশনার কোনো কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি উপজাতীয়দেরকে ‘আদিবাসী’ হিসাবে চিিহ্ণতকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে আদিবাসী মন্ত্রণালয় করার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উত্থাপিত হচ্ছে বলে জানা যায়। ইউএনডিপি. ডানিডা, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং উপজাতীয়দের ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এইসাথে উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপে এবং সাংবাদিকেরা বিভিন্ন লেখায় উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসাবে চিহ্ণিত করছে। এরূপ কাজ অব্যাহত রাখলে উপজাতীয়দের ভবিষ্যতে ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়বে। বর্ণিত অবস্থায় বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই যেন ‘উপজাতি’ এর পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ হিসাবে উল্লেখ না করা হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলে যে সমস্ত এনজিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কার্যক্রমের উপর নজরদারী বৃদ্ধিকরণসহ সতর্কতামূলক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো”।
এদিকে ২০১১ সালের মে মাসে আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘেরস্থায়ী ফোরামের (ইউএনপিএফআইআই) অধিবেশনের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ বৈঠকে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তিবাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর একটি প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিরবাস্তবায়ন নিয়ে অধিবেশনে উপস্থাপন করা প্রতিবেদনে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকলার্স আন্দ্রেস বায়ের বলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে ওই চুক্তি বাস্তবায়িতহচ্ছে না। পাবর্ত চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের মানবাধিকারলঙ্ঘিত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তিমিশনের কোনো দেশের সেনা সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার আগে তাদের মানবাধিকাররেকর্ড পরীক্ষা করে দেখারও সুপারিশ করেন বায়ের। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি করে আসছে। তাদের এই দাবি পূরণের জন্য সরকারেরপ্রতি আহ্বান জানান ইউএনপিএফআইআই-এর অধিবেশনে যোগদানকারী বিভিন্ন আদিবাসীসংগঠনের প্রতিনিধিরা।নিউইয়র্কে আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামে (ইউএনপিএফআইআই) পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক দশম অধিবেশনের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ বৈঠকে ফোরামের সাবেক সদস্য লার্স-অ্যান্ডার্সবায়ের এ সুপারিশ করেন বলে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে জানানো হয়।
১৯৯৭সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদনউপস্থাপন করে তিনি বলেন, “ওই অঞ্চল এখনো সেনা অধ্যুষিত। সেনা সদস্যদেরমাধ্যমে সেখানে আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে।” ওই এলাকায় দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।ইউএনপিএফআইআই-এর সাবেক সদস্য লার্স অ্যান্ডার্স বায়ের ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সদস্য, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদেরসঙ্গে কথা বলে ‘ ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেন। ফোরামের নবম অধিবেশনে বাংলাদেশের ওপর প্রতিবেদনটি তৈরির দায়িত্ব পান তিনি। ১৯ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে ১১৯ বার আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা ছাড়াও তাদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, লারসএন্ডারস পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) কমিশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সফরকরে প্রতিবেদন তৈরি করেন স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার হিসেবে। বিষয়টি প্রতারণা ওউদ্দেশ্যমূলক।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কার্যনির্বাহী পর্ষদকে বায়ের প্রস্তাব দিয়েছেন, “কোনো দেশের সেনা সদস্যদের জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের অনুমোদন দেওয়ার আগে অবশ্যই তাদের মানবাধিকার ইতিহাস নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।” ২০১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উপস্থাপিত ওই প্রতিবেদনে স্থায়ী ফোরামের দ্বাদশ অধিবেশন আদিবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কৌশলগত আলোচনা আয়োজনেরও সুপারিশ করা হয়। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় ১১টি আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে। সেখানকার ৫০০ অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পের মধ্যে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় ২০০টি প্রত্যাহার করা হয়। এরপর একই বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে প্রত্যাহার করা হয় আরো ৩৪টি। তবে ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাস এখনো সেখানে রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া এ তথ্যের সঙ্গে একমত নন অ্যান্ডার্স বায়ের। তিনি বলেছেন, সরকারের এই তথ্য অন্য প্রতিবেদনের সঙ্গে মেলে না। সবগুলো অস্থায়ীক্যাম্প প্রত্যাহারের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়ারও সুপারিশ করেন তিনি।
বায়ের বলেন, “এই ফোরামে বিষয়টি নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন বেড়েই চলছে।” ইউএনপিএফআইআই-এর ঐ সম্মেলনে একটি আদিবাসী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়। তিনি জাতিসংঘ ফোরামে ২০১১-১৩ সালের জন্য নির্বাচিত একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য। ১৬ মে ২০১১ সালে শুরু হওয়া ১২ দিনব্যাপী এ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদারের নেতৃত্বে একটি বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলের অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, “দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থেই সেনা প্রত্যাহার জরুরি।”
এশিয়া ইনডিজেনাস পিপলস ককাসের আদিবাসী প্রতিনিধি রুক্কা সমবলিঙ্গি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবিলম্বে সব ধরনের সেনা স্থাপনা প্রত্যাহারের দাবি জানান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ সদস্যই ওই এলাকায় রয়েছে- এমন তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, “… অথচ সেখানে যুদ্ধ হচ্ছে না, বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতাও সেখানে নেই।” পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরমঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধানেই সেসময় শান্তি চুক্তি করা হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে চুক্তির খুব সামান্যই বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার দেশগুলোর অন্যতম ডেনমার্কের স্টিন হানসেন বলেন, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এ বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে ওই এলাকায় ফের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।” অধিবেশনে স্যামি কাউন্সিলের প্রতিনিধিত্বকারী নাইকো ভলকেয়াপা গত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে হওয়া সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নর্থ আমেরিকা ইনডিজেনাস পিপলস’ ককাসের প্রতিনিধি সেলেস্ট মেকায়ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের দাবি জানান।
এ অধিবেশন চলাকালে বাইরে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সাবেক চেয়ারম্যান ভিক্টোরিয়া টাউলি কর্পাজ ২০০৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি অভিযোগ করেন, সেখানে সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে পাহাড়িদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
কর্পাজ বলেন, “সেনা বাহিনীকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের সহিংসতার তদন্তপূর্বক বিচার হওয়া জরুরি।” অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কৃতি রঞ্জন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনীকে পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই এলাকা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কার্যত ক্ষমতাহীন। সেনা সদস্যদের আধিপত্যের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।” ‘আদিবাসীদের’ ভূমি দখলের জন্য বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সেনাবাহিনী সমর্থন দিচ্ছে বলেও আমরা শুনেছি।” সামিকাউন্সিলের সভাপতি ম্যাতিয়াস আহরেন বলেন, “কয়েক বছর আগে আমি পর্বত্য চট্টগ্রাম সফরে গিয়েছিলাম। ওই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনাতীত, তবে সেখানে বিপুল সংখ্যক সেনাসদস্যের উপস্থিতি আমাকে দুঃখ দিয়েছে।” যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আদিবাসীদের মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল জুম্ম অর্গানাইজেশন ওফ্রেন্ডস অব সিএইচটি বাংলাদেশ এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজনকরে।
অবশ্য জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের ফার্স্ট সেক্রেটারি ইকবাল আহমেদ অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি বায়েরের দেওয়া প্রতিবেদন প্রত্যাখান করেন। বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই দাবি করে তিনি বলেন, এই কারণে শান্তি চুক্তি নিয়ে এই ফোরামে আলোচনার কোনো অবকাশও নেই।
ওই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে ঢাকায় বিদেশি মিশন প্রধানদের মাধ্যমে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সারা বিশ্বকে জানান, এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী নয়। বাঙালি নৃ-গোষ্ঠীই এ ভূখণ্ডে চার হাজার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বসবাস করছে। আদিবাসী হিসেবে দাবি করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো ১৬ শতকের আগে এ ভূখণ্ডে ছিল এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিদেশি মিশনগুলোর প্রধানদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দীপু মনি বলেছেন, “১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এরপর স্বার্থান্বেষী কিছু মহল উপজাতি শব্দকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, পরিচয়কে চ্যালেঞ্জ করে জাতিসংঘ ফোরাম ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ সুবিধা আদায় করতে চাইছে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শক্ত অবস্থান আচঁ করতে পেরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিদেশী রাষ্ট্রদূত ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিগণ বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতে আরো আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপুমণি তাদের দৃঢ়তার সাথে বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় ও সুস্পষ্ট। কাজেই ভবিষ্যতে এ নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার কখনোই বাংলাদেশের উপজাতীয় বাসিন্দাদের ‘আদিবাসী’ বলে সরকারীভাবে স্বীকার করেনি। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো সরকারী মন্ত্রী এমপিসহ সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে উপজাতিদের আদিবাসী বলে বক্তৃতা বিবৃতি দিযে আসছে। বর্তমান সরকারও শুরু থেকেই পার্বত্য উপজাতিদের দাপ্তরিকভাবে ‘আদিবাসী’ বলে স্বীকার করেনি। সেকারণেই ব্যাপক দাবী সত্ত্বেও মানবাধিকার কমিশনে ও ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে’ ‘উপজাতি’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানে উপজাতিদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগ থেকে জারী করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সরকারীভাবে জানানো হয় যে, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই এবং একই সাথে বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ না বলতে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কতিপয় নেতা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজেদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিয়ে আর্থিক সহায়তাসহ তাদের নানা কর্মসূচী বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠে।
বিশেষ করে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন ভারত ও মায়ানমারের বিশাল এলাকার বাসিন্দাদের জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সহায়তায় ব্যাপকহারে খ্রিস্টানকরণ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ইসরাইল বা পূর্ব তিমুরের মতো স্বতন্ত্র খ্রিস্টান ‘বাফার স্টেট’ তৈরীর পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে বাংলাদেশ সরকারের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট মহল সতর্ক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ তার সদস্যভূক্ত কোনো দেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে এ মর্মে ক্লজ থাকায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেই চার্টারে স্বাক্ষর দিতে আপত্তি জানায়। এরই প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের permanent forum for indigenous people -এর ৭ম অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্কারভাবে জানায়: `The country has some tribal population and there are no indigenous people.’
এরপর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৬৩ তম অধিবেশনের আলোচ্যসূচীতে আদিবাসী প্রসঙ্গ থাকায় বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে জানতে চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র, সমাজকল্যাণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে চিঠি লেখে। এর উত্তরে ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একই কথা জানায়। [(স্মারক নং- পাচবিম(সম-১)৩৭/৯৭-১১৭ তারিখ: ৯/৯/২০০৮) : :`The country has some tribal population and there are no indigenous people.’