অধ্যাপক মাহফুজ আহমেদ
পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে বাংলাদেশে প্রতি বছরের মতো এ বছরও আগামীকাল ৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ পালিত হবে। অস্ট্রেলিয়ান এবরিজিন, যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ান, নিউজিল্যান্ডের মাউরি, দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা ও মায়া, জাপানের আইনু, রাশিয়ার মেনেট, ফ্রান্স ও স্পেনে বাসকু, আরব বেদুইন প্রভৃতি জনগোষ্ঠী প্রাচীন কাল থেকেই আদিবাসী হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। বাংলাদেশে আদিবাসী কারা-এই নিয়েও একটি বিতর্ক ইদানীং চালু হয়েছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর যে অংশটি নিজেদের হঠাৎ আদিবাসী বলে দাবি করতে শুরু করছে তারা কিন্তু কয়েক বছর আগেও নিজেদের এ পরিচয়ে পরিচিত করাতে চায়নি। তারা দীর্ঘ দিন ধরে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা অথবা নিজস্ব গোত্র পরিচয়েই পরিচিত হবার দাবি করে আসছিল। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples অর্থাৎ ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ জারি হওয়ার পর হঠাৎ করে তারা নিজেদের আদিবাসী বলে দাবি করতে শুরু করেন। এরকম হঠাৎ করে আদিবাসী হতে চাওয়ার নজির বিশ্বে আর কোথাও নেই। ইস্যুটি পুরাতন না হলেও তা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, অখ-তা ও সার্বভৌমত্বের উপর প্রভাব ফেলেছে।
যে বিষয়টি সবচেয়ে ভয়ংকর এবং আত্মঘাতী তা হচ্ছে আমাদের মিডিয়া ও সুশীল সমাজের একটি অংশের জোরাল সমর্থন ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তারা ইতোমধ্যে বিষয়টিকে মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সরকার তাদের দাবির কাছে কিছুটা নমনীয় হয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে এ সকল জাতিসত্ত্বাকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর এই সুযোগে ‘তফসিলী সম্প্রদায়’ভুক্ত জনগোষ্ঠীও (যারা উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হওয়ার বৈশিষ্ট্যধারী নয়) ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। অথচ এ সকল জনগোষ্ঠীর মূল অংশ ভারতে এখনো সাংবিধানিকভাবে ‘তফসিলী সম্প্রদায়’ (Schedule Cast) হিসেবে চিহ্নিত, পরিচিত ও সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
আদিবাসীর সংজ্ঞা ও জাতিসংঘ কনভেনশন/ঘোষণা
আদিবাসী বিতর্কের সমাধানে প্রথমেই আমাদের আদিবাসীর সংজ্ঞা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। আদিবাসী বিষয়ে দুই ধরনের সংজ্ঞা পাওয়া যায়। একটি আভিধানিক সংজ্ঞা এবং অন্যটি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত সংজ্ঞা। প্রথমেই দেখা যাক আভিধানিক সংজ্ঞায় আদিবাসী মানে কী? আদিবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Indigenous People. অনেকে আবার আদিবাসী শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে Aborigine শব্দটি ব্যবহার করেন। যাতে প্রকৃতপক্ষে সার্বজনীনভাবে আদিবাসী বোঝায় না। Aborigine বলতে সুনির্দিষ্টভাবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বোঝায়। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে Aborigine শব্দের অর্থ বলা হয়েছে, A person, animal or plant that has been in a country or region from earliest times; An aboriginal inhabitant of Australia. একইভাবে Red Indian বলতে যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসীদের বোঝায়; অস্ট্রেলিয়ান এবরিজিন বা আদিবাসীদের বোঝায় না। এ ছাড়াও বিভিন্ন ডিকশনারিতে আদিবাসী বিষয়ে যে সকল সংজ্ঞা ও প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে : Aborigine: earliest, primitive, a member of a race of people who were the original living in a country, specially Australia.
অন্যদিকে বিভিন্ন অভিধানে নিম্নরূপে Indigenous- এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে; Indigenous: belonging to a particular place rather than coming to it from somewhere else. চেম্বার্স ডিকশনারিতে Indigenous, Native born, originating or produced naturally in a country, not imported. এখানে Indigenous শব্দের বিপরীত শব্দ হিসেবে exotic শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে ‘বহিরাগত’। আভিধানিকভাবে আদিবাসী শব্দের অর্থ দেশি, স্বদেশজাত বা ভূমিপুত্র। একইভাবে বাংলা একাডেমির অভিধানে Indigenous শব্দের অর্থ বলা হয়েছে: দেশি, দৈশিক, স্বদেশীয়, স্বদেশজাত। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ অভিধানে Indigenous শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে: স্বদেশজাত, দেশীয়। অন্যদিকে নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় আদিবাসী হচ্ছে কোনো অঞ্চলের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা Son of the Soil. প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী ‘আদিবাসী হচ্ছে কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই’।
এখন দেখা যাক জাতিসংঘ উপজাতি ও আদিবাসীর সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারণ করেছে। উপজাতি ও আদিবাসী বিষয়ে জাতিসংঘ ও এর অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত প্রধানত তিনটি চার্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। (১) জাতিসংঘের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার International Labour Organization (ILO) ১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত ৪০তম অধিবেশনে প্রদত্ত Indigenous and Tribal Populations Convention-1957 (No.107); (২) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত Indigenous and Tribal Populations Convention -1989 (No.169) এবং (৩) ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples বা ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’।
উপর্যুক্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রথম চার্টার দুটি (No.107 ও No.169) বিশেষভাবে লক্ষণীয় যাতে আদিবাসী ও উপজাতি বিষয়ক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সংযোজন করা হয়েছে। এই কনভেনশন দুটিতে উপজাতি ও আদিবাসীদের জন্য আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। কনভেনশনে পাস হওয়া ধারাগুলো একই সাথে আদিবাসী ও উপজাতি নির্ধারণ এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে; শুধু আদিবাসীদের নয়। অথচ বাংলাদেশে এই চার্টারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একান্তভাবে আদিবাসীদের হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ২০০৭ সালের The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples- শীর্ষক ঘোষণাপত্রটি শুধুমাত্র আদিবাসীদের স্বার্থ-সংশ্লি¬ষ্ট বিষয়াদি নিয়ে। এই ঘোষণাপত্রটিতে উপজাতিদের বিষয়ে কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি; এমনকি আদিবাসীদের সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়নি।
উপর্যুক্ত দুটি সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী সংজ্ঞার মূল পার্থক্য হচ্ছে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার বা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করা। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি একই রকম। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠী উপজাতি অথবা আদিবাসী হবেন উপর্যুক্ত শর্তের ভিত্তিতে। আইএলওর এই সংজ্ঞাটি যদি বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণের ক্ষেত্রে বিচার করা হয় তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায় এরা আদিবাসী নয়; উপজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া ও সুশীল সমাজের কিছু ব্যক্তিবর্গ জাতিসংঘ কনভেনশনের উপস্থাপিত সংজ্ঞাটির Tribal বা ‘উপজাতি’ অংশটি সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু Indigenous বা ‘আদিবাসী’র সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করেন।
এখন পর্যবেক্ষণ করা যাক, বাংলাদেশের জন্য ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনের United Nation Declaration on the Rights of Indigenous Peoples বা ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’, প্রযোজ্য কিনা। ঘোষণাপত্রটির উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এটি অনেক ক্ষেত্রে সংগতিপূর্ণ নয় এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং এই ঘোষণাপত্রের নিম্নোক্ত ধারাগুলো বিশেষভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন :
Article 3 : Indigenous peoples have the right to self-determination. By virtue of that right they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural development. অর্থাৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতিক কর্ম প্রয়াস অব্যাহত রাখতে পারবে।
Article 4 : Indigenous peoples, in exercising their right to self-determination, have the right to autonomy or self-government in matters relating to their internal and local affairs, as well as ways and means for financing their autonomous functions. অর্থাৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার চর্চার বেলায় তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে এবং তাদের স্বশাসনের কার্যাবলীর জন্য অর্থায়নের পন্থা ও উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার থাকবে।
Article 5 : Indigenous peoples have the right to maintain and strengthen their distinct political, legal, economic, social and cultural institutions, while retaining their right to participate fully, if they so choose, in the political, economic, social and cultural life of the State. অর্থাৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনী, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ণ রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার থাকবে।
Article 10 : Indigenous peoples shall not be forcibly removed from their lands or territories. অর্থাৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি বা ভূখণ্ড থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে উৎখাত করা যাবে না।
Article 20 : 1. Indigenous peoples have the right to maintain and develop their political, economic and social systems or institutions. অর্থাৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী তাদের জীবন-জীবিকা উন্নয়নের নিজস্ব ধারা নিশ্চিত করার জন্য এবং তাদের ঐতিহ্যগত ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্বাধীনভাবে নিযুক্ত থাকার জন্য তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান বজায় রাখা ও উন্নয়নের অধিকার থাকবে।
Article 30 : 1. Military activities shall not take place in the lands or territories of indigenous peoples, unless justified by a relevant public interest or otherwise freely agreed with or requested by the indigenous peoples concerned. অর্থাৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি কিংবা ভূখন্ডে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যাবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত উপযুক্ত জনস্বার্থের প্রয়োজনে যুক্তিগ্রাহ্য হবে, অন্যথায় যদি সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় সম্মতি স্থাপন বা অনুরোধ করে।
উপরোক্ত ধারাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে United Nation Declaration on the Rights of Indigenous Peoples বা ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ অনুসারে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বতন্ত্র তথা স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি তারা মনে করে যে তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকবে না বা ভারতেও যোগ দেবে না; তবে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকলেও তারা যে অঞ্চলে বাস করে সেই অঞ্চলের ভূমির মালিকানা বাংলাদেশের হবে না এবং সে অঞ্চলে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসন, স্বশাসিত সরকার ও তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক ও আইনী কার্যক্রম এবং তা পরিচালনার জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত হলে প্রকারান্তরে তা এই অঞ্চলের উপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করবে।
Indigenous and Tribal Populations Convention-1957 (No.107) ১৯৫৭ সালে পাস হলেও এ পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৭টি দেশ এই কনভেনশনটি র্যাটিফাই করেছে। ১৯৭২ সালের ২২ জুন বাংলাদেশও কনভেনশন ১০৭ র্যাটিফাই করেছিল। পরে কনভেনশন ১৬৯ পাস হওয়ার পর পূর্বোক্ত কনভেনশন ১০৭ তামাদি হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ অদ্যাবধি কনভেনশন ১৬৯ র্যাটিফাই করেনি। তাই এটি আমাদের দেশের জন্য অবশ্য পালনীয় নয়। এখানে লক্ষণীয় যে এরই মধ্যে ৮টি দেশ এই কনভেনশনকে নিন্দা করে তা থেকে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে Indigenous and Tribal Populations Convention-1989 (No.169), ১৯৮৯ সালে পাস হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২২টি দেশ এই কনভেনশনটি র্যাটিফাই করেছে। এই উপমহাদেশের একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোনো দেশ এই কনভেনশনটি র্যাটিফাই করেনি।
অন্যদিকে, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক যে ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ভোটদানের সময় ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র।
বিস্ময়কর অথবা পরিহাসের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের তথাকথিত আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় খুব সোচ্চার ও পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু নিজ দেশের জন্য আইএলও কনভেনশন ১০৭ বা ১৬৯ ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণা পত্রের সিগনেটরি নয়, পক্ষে ভোট দেয়নি এবং র্যাটিফাইও করেনি। কাজেই তাদের কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণের কারণ ও মতলব বুঝতে সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। এসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর উপজাতি, আদিবাসী কিংবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য এই মায়াকান্নার পেছনে মূলত ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি আধিপত্যবাদী স্বার্থই প্রকাশ্যে কিংবা অবচেতনে প্রবলভাবে কাজ করেছে-একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
তাহলে বাংলাদেশে সত্যিকার আদিবাসী কারা : নিঃসন্দেহে বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষীরা এদেশের সত্যিকারের আদিবাসী। কারণ তারাই প্রোটো-অস্ট্রোলয়েড (Proto Astroloid) নামে আদি জনধারার অংশ এবং তারাই একমাত্র আদিবাসী বা Son of the Soil বলে দাবি করতে পারে। এর পেছনে জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রমাণও রয়েছে। বাংলাদেশের এই অঞ্চলে বাঙালিরা বসবাস করে আসছে চার হাজার বছরেরও পূর্বে থেকে। বিক্রমপুর, ওয়ারি-বটেশ্বর, সোনারগাঁ কিংবা মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত নৃতাত্ত্বিক প্রমাণাদি এসব বিষয় নিশ্চিত করে। নৃতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস বিশ্লেষণে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত যে, বাংলাদেশে বসবাসরত কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এ দেশের আদিবাসী নয়-বিশ্বের তাবৎ শীর্ষস্থানীয় নৃবিজ্ঞানী এবং গবেষণাকারীরা এ ব্যাপারে একমত।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান উপজাতি চাকমাদের আদি বাসস্থান ছিল আরাকান, ত্রিপুরাদের আদি বসবাস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এবং মারমা জনগোষ্ঠী এসেছে বার্মা থেকে। সেই অর্থে তারা কেউই বাংলাদেশের আদিবাসী নয় বরং অভিবাসী। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে দেশান্তরী হয়ে এদেশের নানা স্থানে অভিবাসিত হয়ে আনুমানিক তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ বছর পূর্ব থেকে বাংলাদেশ ভূখন্ডে বসবাস করতে শুরু করেছে। তাই কোনোক্রমেই বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী হতে পারে না।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো যে আদিবাসী নয় তার প্রমাণ : বাংলাদেশের উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো এদেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয় তার প্রমাণ প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ Robert Henry Sneyd Hutchinson তাঁর বই An Account of Chittagong Hill Tracts (1906), Captain Thomas Herbart Lewin (1869), তাঁর বই The Chittagong Hill Tracts and Dwellers Therein (1869), অমেরেন্দ্র লাল খিসা (১৯৯৬) প্রমুখের লেখা, গবেষণাপত্র, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। তারা সবাই একবাক্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতীয়দের নিকট অতীতের কয়েক দশক থেকে নিয়ে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এদেশে স্থানান্তরিত বা অভিবাসিত হওয়ার যুক্তি প্রমাণ ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জাতি বহির্ভূত অন্য সকল উপজাতীয় গোষ্ঠীই এখানে তুলনামূলকভাবে নতুন বসতি স্থাপনকারী। এখানকার সবচেয়ে আগের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ম্রো, খিয়াং, পাংখো এবং কুকিরা মূল ‘কুকি’ উপজাতির ধারাভুক্ত। ধারণা করা হয়, এরা প্রায় তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেছিল। চাকমারা আজ থেকে মাত্র আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ বছর পূর্বে মোগল শাসনামলের শেষ থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে (খবরিহ ১৮৬৯)। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং ব্রিটিশ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক Thomas Herbart Lewin- এর মতে, A greater portion of the hill tribes at present living in the Chittagong Hill Tract undoubtedly came about two generations ago from Arakan. This is asserted both by their own traditions and by records in Chittagong Collect-orate. It was in some measure due to the exodus of our hill tribes from Arakan that the Burmese war of 1824 took place … hired in a great measure upon refugee from hill tribes who, fleeing from Arakan into territory, were purshed and demanded at our hands by the Burmese. (Lewin 1869, pp 28-29). অর্থাৎ মাত্র দুই পুরুষ আগে ব্রিটিশদের সাথে বার্মা যুদ্ধের সময় চাকমারা পার্বত্য অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে যা চট্টগ্রাম কালেক্টরেট অফিসে দলিল দস্তাবেজ থেকে নিশ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলের মারমা জনগোষ্ঠী ১৭৮৪ সনে এ অঞ্চলে বার্মা থেকে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং বসবাস শুরু করে (Shelley, 1992 and Lewin, 1869).
পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এসব জনগোষ্ঠীগুলোর প্রায় সবাই যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং হিংস্র দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে তাদের পুরাতন আবাসস্থল থেকে এখানে পালিয়ে এসেছ অথবা এক জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর পশ্চাদ্ধাবন করে আক্রমণকারী হিসেব এদেশে প্রবেশ করেছে। বিশিষ্ট চাকমা পন্ডিত অমেরেন্দ্র লাল খিসা ‘অরিজিনস অব চাকমা পিপলস অব হিলট্রেক্ট চিটাগং’-এ লিখেছেন, ‘তারা (চাকমারা) এসেছেন মংখেমারের আখড়া থেকে। পরবর্তীতে আরাকান এবং মগ কর্তৃক তাড়িত হয়ে বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করেন। আজ থেকে আড়াইশ-তিনশ বছর পূর্বে তারা উত্তর দিকে রাঙামাটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন।’ বাংলাদেশে এ বিষয়ে যারা গবেষণা করেছেন এবং প্রবন্ধ লিখেছেন যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুর রব, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. খুরশীদা বেগম, বিজয় কী বোর্ডের উদ্ভাবক মোস্তফা জব্বার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করছেন এমন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয়।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী আখ্যায়িত করলে অসুবিধা কী : অনেককেই এটি বলতে শোনা যায় যে, আদিবাসী বললে যদি ওরা খুশী হয় বা খুশী থাকে তাহলে সমস্যা কী? বিভিন্ন লেখা এবং দুই একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনেও অবচেতনভাবে তাদের আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে তাতে এখনই কোনো সমস্যা মনে নাও হতে পারে কিন্তু পরবর্তীসময়ে ‘ইষ্ট তিমুর’ কিংবা ‘সাউথ সুদান’-এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার দায়ভার নিতে কি আমাদের সেই সব বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়া প্রস্তুত আছেন? সকলের জ্ঞাতার্থে এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ‘ইস্ট তিমুর’ এবং ‘সাউথ সুদান’-এর মতো পরিস্থিতি কাশ্মীর, চেচনিয়া, ফিলিপাইনের মিন্দনাওসহ পৃথিবীর আরও কিছু স্থানে বিরাজ করলেও সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত করে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নিকটবর্তী দেশ মিয়ানমারে আরাকানী মুসলিমদের সাথে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কতটা সহানুভূতিশীল ভূমিকা রাখছে তা-ও পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।
আসল কথা হচ্ছে যে, United Nation Declaration on the Rights of Indigenous Peoples বা ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ ২০০৭ অনুযায়ী তাদের আদিবাসী স্বীকৃতি প্রদান করলে সেই অনুযায়ী তাদের স্বায়ত্তশাসন, রাজনৈতিক, আইনী, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা প্রদান করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। বিশেষ করে এই ঘোষণার ধারা ৩০ অনুযায়ী ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি কিংবা ভূখ-ে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না উপযুক্ত জনস্বার্থের প্রয়োজন যুক্তিগ্রাহ্য হবে, অন্যথায় যদি সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ না করে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর ভূমি বা ভূখ- ব্যবহারের আগে যথাযথ পদ্ধতি ও বিশেষ করে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লি¬ষ্ট বিশেষ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি গ্রহণ করার বিষয়টি সেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলেই অনুমেয়। এছাড়া উল্লি¬খিত জাতিসংঘ ঘোষণার অসংগতি পূর্ণ বিষয়গুলো যেমন ‘উপযুক্ত জনস্বার্থের’ সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা কী? বাংলাদেশ সরকার জেএসএস, ইউপিডিএফ এবং সংস্কারবাদীদের সাথে আলোচনা করবে? এই দলগুলোর মতবাদও তো এক নয়। ‘স্বেচ্ছায় যদি সম্মতি জ্ঞাপন’ না করে তারা তাহলে কী হবে? যদি কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বহির্বিশ্বের কারো সঙ্গে কোনো অশুভ আঁতাত করে? যদি বহির্বিশ্ব থেকে ওই অঞ্চল আক্রান্ত হয়, সরকার কি সামরিক কার্যক্রম গ্রহণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কারো সম্মতির অপেক্ষায় নিষ্ক্রিয় থাকবে? যদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেতৃত্ব সম্মতি না দেয় তাহলে কী হবে? এছাড়াও বাংলাদেশে কমবেশি ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ‘মালিকানাধীন’ ভূমি আছে এবং তারা যদি সেই ভূমি বা ভূখণ্ড ব্যবহারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর এত বিধি-নিষেধ আরোপ করতে থাকে তাহলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কী হবে?
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুর রবের অভিমত, ‘একশ্রেণীর মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। এক কথায় বললে এরা মূর্খ। এদের কারো এনথ্রোপলজি, সোসিওলোজি, ইতিহাস, ভূগোল এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও উপজাতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। আর যারা জেনে বুঝে এ কাজ করছে তারা বিভিন্ন পারিতোষিক, বৃত্তি, উচ্চ বেতনের চাকরি প্রভৃতির লোভে করছে। প্রিন্ট/ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা এনজিও কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর প্রভাবশালীরা লোভের বশে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এমন মিথ্যাচার করছে। কাজেই আমাদের সকলকে এই বিষয়টিতে সতর্ক হতে হবে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী বলা বন্ধ করতে হবে।’
চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা আমাদের মোট ভূখণ্ডের দশভাগের একভাগ (১৩,২৯৫ বর্গকিমি/৫,১৩৩ বর্গমাইল) এবং এখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা এক ভাগ (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৫,৯৮,২৯১ জন) মানুষ বাস করে। এ এলাকায় জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে যারা অবচেতনে উস্কে দিচ্ছে তারা জানে না যে, এখানে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। অভিবাসন, নৃতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিকসহ অন্যান্য সকল বিবেচনায়ই তারা এই ভূখণ্ডের মূল বা আদি বাসিন্দা নয়। বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো এখানকার আদিবাসীও আসলে বাঙালিরা। তবে এদেশের সকল নাগরিকের মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের অল্প কিছুদিন আগে থেকে দাবিকৃত আদিবাসী হওয়ার প্রবল ইচ্ছা আসলে জাতিসংঘের ২০০৭ সালের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন ধারা থেকে ভবিষ্যতে ফায়দা লোটার কৌশল। এই কৌশলের ফাঁদে পা দেওয়া ভয়ংকর এবং বিপজ্জনক। কারণ তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ তার এক দশমাংশ ভূমির মালিকানা হারাতে পারে যার সাথে আমাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত। কাজেই সকলকে সতর্ক হতে হবে এবং এদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী বলা বন্ধ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ উন্নয়ন গবেষক।