ডেস্ক নিউজ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে শিগগিরই মালদ্বীপের মালেতে সরাসরি বিমানের ফ্লাইট ও জাহাজ চলাচল শুরু হতে যাচ্ছে। দুই দেশের সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার বিকালে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ শহিদের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এদিন দুদেশের মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ঘোষণা করেছেন, শিগগিরই বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে যাবে বাংলাদেশ বিমান। আরেকটি সুখবর হচ্ছে-শিগগিরই চট্টগ্রাম ও মালের মধ্যে আমরা একটি শিপিং লাইন চালু করব।
তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) সই করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। মালদ্বীপ তাতে সম্মত হয়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখনো খুব বেশি আমরা অগ্রসর হইনি। এজন্য আমরা ওদের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছি যে, আমরা প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) করতে চাই। যেটা ভুটানের সঙ্গে আমরা করলাম কিছুদিন আগে। ডাবল ট্যাক্সেশন যাতে না হয়, সেজন্য একটা প্রস্তাব আমরা দিয়েছি এবং কাস্টমসের ওপর আমরা কাজ করছি। উভয় দেশ প্রমোশন অ্যান্ড প্রটেকশন অব ইনভেস্টমেন্টের ওপরও আমরা কাজ করছি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী, ওষুধসহ অন্যান্য পণ্য যাতে আরও বেশি পাঠানো যায়, এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ফিশারিজ, পর্যটনে মালদ্বীপের সঙ্গে কীভাবে সহযোগিতা বাড়ানো যায়, কানেকটিভিটি কীভাবে বাড়োনো যায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে।
চারটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা তুলে ধরে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ শহিদ বলেন, আমরা সমন্বিত যৌথ কমিশন করতে যাচ্ছি, যাতে দৃঢ় আইনি ভিত্তি ও কাঠামোর ওপর ভর করে আমরা সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি। এর মাধ্যমে নিয়মিত সব ইস্যুকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারব। তিনি বলেন, আমরা প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট চুক্তির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করেছি। কাস্টমস সংক্রান্ত বিষয়ে যাতে ডাবল ট্যাক্সেশন এড়ানো যায়। এই সমঝোতা স্মারকগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নের বিষয়েও দুপক্ষ একমত হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক বিষয়ে মালদ্বীপ বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন শহিদ।
এর আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহর সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে তাদের উপস্থিতিতে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এমএম ইমরুল কায়েস যুগান্তরকে জানান, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানান। দুই নেতা প্রথমে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। পরে দুই দেশের প্রতিনিধিদল দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসে। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের এ বিষয়ে ব্রিফ করেন।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পরে মৎস্য এবং সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন খাতে ৪টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এর মধ্যে ‘জয়েন্ট কমিশন ফর কম্প্রিহেনসিভ কো-অপারেশন’ গঠনে একটি এমওএইউ স্বাক্ষর করেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব সই করেন ‘বাইলেটারাল ফরেইন অফিস কনসাল্টেশন’ বিষয়ক এক সমঝোতা স্মারকে। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে দুই দেশের সহযোগিতা বাড়াতে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেন বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং মালদ্বীপের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রী। এছাড়া বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি বিনিময় বিষয়ে একটি এমওইউ সই করেন।
বৈঠক শেষে প্রেস সচিব বলেন, দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যুব উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং ফার্মাসিউটিক্যালসহ সম্ভাবনাময় একাধিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারে একমত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট সোলিহ ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মোকাবিলা করা সব ইস্যুতে সমাধান খুঁজতে বিভিন্ন ধরনের সিএসএলএম আমদানির জন্য মালদ্বীপের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ মালদ্বীপের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়নে অব্যাহত সহযোগিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ মালদ্বীপের শান্তিরক্ষীদের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং (বিআইপিএসওটি) প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট সোলিহ বলেন, ‘মালদ্বীপে সব বাংলাদেশি প্রবাসীকে বিনা মূল্যে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া হবে, প্রধানমন্ত্রী এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন।’
তিনি মালদ্বীপের মেডিকেল প্রফেশনালদের ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার প্রস্তাব করেন। সোলিহ দুই দেশের অর্থনীতিতে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অবদানের প্রশংসা করেন। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে দুই নেতা জাতিসংঘ এবং জলবায়ু ফোরামসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফরমে একত্রে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছেন।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বাংলাদেশ মালদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। মালদ্বীপ গভীর সমুদ্র থেকে টোনা ফিশ আহরণে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। তিনি বলেন, উভয় দেশের সম্ভাবনাময় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পর্যটন ও বিমান যোগাযোগ সুবিধা দেবে।
এলজিআরডি এবং সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। মালদ্বীপের পক্ষে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লা শহিদ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রী ফাইয়াজ ইসমাইল, বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক সচিব সাবরা ইব্রাহীম নরদেন এবং পররাষ্ট্র সচিব আবদুল গফুর মোহাম্মদ। পরে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রক্ষিত পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। পরে বঙ্গভবনে তিনি রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় যোগ দেন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন। দুইদিনের সফরে বুধবার সকালে ঢাকায় আসেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট।