চীন ১৪০ কোটি মানুষের বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশকে চীন তার বাজারে আট হাজার ২৫৬ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধার কারণে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন করে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আগামী অর্থবছরের শুরুতেই এই সম্ভাবনা দৃশ্যমান হবে বলে আশা সংশ্লিষ্ট মহলের।
অন্যদিকে বাংলাদেশে শ্রম মজুরি কম এবং নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা থাকায় এরই মধ্যে চীনের অনেক উদ্যোক্তা বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তরের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন করে সেই পণ্য নিজ দেশে রপ্তানি করবেন।
ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, চীনের বাজারে যেসব পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা আছে তার ৯৭ শতাংশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশও এ সুবিধা পাবে। ১ জুলাই থেকে এটা কার্যকর হওয়ার কথা। তবে চীনের পাঠানো পণ্যের তালিকা সে দেশের ভাষায় হওয়ায় তাতে কী কী পণ্য আছে তা চূড়ান্ত করা যায়নি। বর্তমানে অনুবাদ নিয়ে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) ওবাংলদেশে চীনের দূতাবাস।
এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, চীন শুল্ক সুবিধা দিলেও এসব সুবিধা পেতে কিছু শর্ত রয়েছে। এসব শর্তসহ সুবিধাদি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে কিভাবে এই সুযোগ কাজে লাগানো যায়। চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘দেশটির অনেক বিনিয়োগকারী এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাদের আমরা বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তরের আহ্বান জানাচ্ছি। বিপুল সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। তবে চীনের দেওয়া রপ্তানি সুবিধা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা দৃশ্যমান হতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী অর্থবছর পর্যন্ত।’
উদ্যোক্তারা জানান, চীনের বাজারে পণ্য রপ্তানির জন্য সরকার তৈরি পোশাক, ওষুধ, আসবাব, চামড়া, চামড়াজাত পণ্যে নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য বহুমুখীকরণে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। প্রতিযোগিতা করেই বিশ্বের ১৪০টি দেশে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। চীনেও পারবেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলেন, চীন তার বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যে সুবিধা দিয়েছে তা কার্যকর হলে মিঠা পানির মাছ, পাট, সামুদ্রিক মাছ, প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি বিশেষভাবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ যারা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে সেটা চীনের বাজারে রপ্তানি করতে পারবে।
বিসিসিসিআই সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের মোট আমদানির ৩৪ শতাংশ আসে চীন থেকে। ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ১০০ কোটি (এক বিলিয়ন) ডলারের কম। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ওই অর্থবছরে চীন বাংলাদেশে প্রায় ১১৬ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
সংগঠনটি জানায়, চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট উদ্যোগে বাংলাদেশ যোগদানের পর থেকে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বেড়েই চলছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে সফরের সময় ২৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়। এটা একক কোনো দেশ হিসেবে বড় বিনিয়োগের অঙ্গীকার ছিল। এ ছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে চীনের একটি বড় কেমিক্যাল কম্পানিকে ১০০ একর জমি দিয়েছে বাংলাদেশ। আরো বহু কম্পানি পাইপলাইনে আছে।
বিসিসিসিআই সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার কারণে চীন বাংলাদেশের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ না থাকায় চীনের দেওয়া সুবিধা দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ আগের তুলনায় বেড়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডা বাংলাদেশ চায়না চেম্বার এই নিয়ে কাজ করছে।’ চীনের বিনিয়োগ আনতে চেষ্টা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরই মধ্যে দেশটির দুটি বড় প্রতিষ্ঠান বায়োটেকনোলজি ও ইলেকট্রিক ভেহিকলের জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আরো চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে বিডা ও চেম্বার একসঙ্গে কাজ করছে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, তৈরি পোশাক খাতের বিশ্ববাজার ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ১২৮ বিলিয়ন ডলার বা বাজারের ৩৫ শতাংশ। চীনের বাজারের ২ শতাংশও যদি বাংলাদেশ পায় তবে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ৫০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি বাড়বে। তিনি বলেন, গত বছর চীনে ৫০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। তবে করোনার কারণে চলতি বছরের গত আট মাসে আয় কম হয়েছে। এ সময় আয় হয়েছে ৩২ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীনসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করতে চায় বিদেশি বিনিয়োকারীরা। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য তাদের পছন্দের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। সনি মোবাইল ও স্যামসাংয়ের মতো কম্পানি চীন থেকে সরে যাচ্ছে। তবে চীনের বিনিয়োগ পেতে হলে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামোর কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। শুধু পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ভরতা কাটিয়ে পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। তাহলেই চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানো যাবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার ফলে দেশের অর্থনীতির জন্য তিনটি বড় সুযোগ তৈরি হলো। চীনে আমাদের পোশাকসহ প্রধান রপ্তানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ হলো। এতে করে বাংলাদেশের জন্য সহজে পণ্য রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সুযোগ তৈরি হলো। এ ছাড়া চীন এবং অন্য দেশের বিনিয়োগকারীরা এখানে তাঁদের পণ্য তৈরি করে চীনে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি করে লাভবান হবেন।’
তৌফিকুল ইসলাম খান আরো বলেন, চীনে মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৩০০ ডলার, এটা বাংলাদেশে মাত্র ১০০ ডলার। মানে এক-তৃতীয়াংশের মতো। ভিয়েতনামে ২০০ ডলার। ফলে চীনে পণ্য উৎপাদন অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। তাই চীনা উদ্যোক্তারা অন্য দেশে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী বেশি। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর ধরে চীনের অনেক কম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা চালাচ্ছে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দরসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বড় দুটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গেও চীন সম্পৃক্ত। চীন এরই মধ্যে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শাহজালাল সার কারখানা ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। এ ছাড়া বিদ্যুৎ জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ খাতে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত।