ডেস্ক নিউজ
বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে সরকারের ১০ মেগা প্রকল্প। ইতোমধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতু। মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ উন্মুক্ত হবে ডিসেম্বরে। এ বছরের অক্টোবরেই চালু হচ্ছে কর্ণফুলী টানেলের প্রথম টিউব, দ্বিতীয় টিউব নভেম্বরে। ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অন্যান্য প্রকল্পের অগ্রগতি ৫০ শতাংশের বেশি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে।
গত ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরদিন সকাল থেকে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু করে। ৪২টি পিলারের উপর ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে গড়ে তোলা পদ্মা সেতু রাজধানীর সঙ্গে বাধাহীনভাবে যুক্ত করেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে। সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।
ভারত সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ৬ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মৈত্রী পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১ যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন। কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে ভারতীয় উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের অর্ধেক অংশ চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। শুরু থেকেই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোর লাইনটি চালু করা হবে দুই ধাপে। উত্তরা-আগারগাঁও অংশ চলতি বছরের ডিসেম্বরে। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ আগামী বছরের ডিসেম্বরের আগেই চালুর কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের ৯৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেলের একটি টিউব এ বছরের অক্টোবরে, আরেকটি নভেম্বরে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে কর্ণফুলীর তলদেশে এই টানেল নির্মাণ করছে সরকার। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার হলেও এর সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের দুই পাশের ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হাইওয়েকে যুক্ত করবে। তা ছাড়া টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যর পর একটি উড়াল সেতুও রয়েছে। টানেলে ১০ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের প্রতিটি টিউবের দূরত্ব অন্তত ১১ মিটার। দুই টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেনে চলাচল করবে যানবাহন। এসব টিউবের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৬ মিটার। টিউবের ভেতরের উচ্চতা ১৬ ফুট।
এছাড়াও বর্তমান সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত (ফাস্ট ট্র্যাক) ১০ প্রকল্পের অন্যসব প্রকল্পের কাজ এগুচ্ছে। যে কোনও কিছুর বিনিময়েই অতিসত্তর এসব প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়ন শেষে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সংশ্লিষ্টরা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে চাইছে সরকার।
সূত্র জানিয়েছে, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৫৬ শতাংশ। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেলের দোহাজারী-ঘুমধুম ডুয়েলগেজ ট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতিও সন্তোষজনক।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য মতে, বর্তমান সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পগুলোর মধ্যে দোহাজারী-রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পসহ ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত অন্য মেগা প্রকল্পগুলোতে কাজের গতি ফিরেছে।
পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে শুধু গাড়িই নয় চলবে রেল। সেজন্য আলাদাভাবে তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প। বর্তমানে পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের রেল লিংক প্রকল্পে রেল স্টেশন, ভায়াডাক্ট, রেল সেতু ও রেল লাইনের কাজ চলছে পুরোদমে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে রাজধানীর রেল সুবিধা দ্রুত সংযুক্ত করতে ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের কাজে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ৩৯ দশমিক ছয় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই অংশে এখন হরদম চলছে কাজ। চীনা ঠিকাদার সিআরইসি রেললাইন, রেল স্টেশন ও রেল সেতু নির্মাণ করছে সেনাবাহিনীর সিএসির তত্ত্বাবধানে। এই অংশের পলাশপুর এলাকায় শুরু হয়েছে পাথরবিহীন রেললাইন বসানোর কাজ। ক্রেনে করে ভায়াডাক্টের ওপর লোহার রেললাইন তোলা হচ্ছে। লোহার গেজ বাফল, ইলাস্টিক ক্লিপ, ফাইবারের ইন্সুলেটার ও ফাসনার কানেক্টর দিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে স্লিপারের সঙ্গে। ঢাকা থেকে যশোর ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্প শেষ হবে ২০২৪ সালে। আর পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রেললাইন চালুর কথা রয়েছে চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর।
১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু, কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ চলছে। এই মেগা প্রকল্পের দোহাজারী থেকে রামু, কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার অংশের কাজ হয়েছে ৭২ শতাংশ। ২০২৩ সালে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ চালু হতে পারে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয়েছে সাত বছর। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে ও দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এক লাখ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে পাবনার রূপপুরে। যেখানে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট করে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এরই মধ্যে প্রকল্পের আওতায় মোট ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
দেশি-বিদেশি বিপুল বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠছে কক্সবাজারের মাতারবাড়ি। এরই মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে এ এলাকায়। ৭৮ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয়ের আরও ছয়টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান। এর বাইরে আরও ৫৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে মাতারবাড়ি ও এর সংলগ্ন মহেশখালী এবং ধলঘাটে। জাপানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকা ঘিরে লজিস্টিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং অন্যান্য শিল্পে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রাথমিক প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার সরাসরি বিনিয়োগ করবেন সে দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তারা। বাকি ১০ বিলিয়ন ডলার সহজ শর্তে বাংলাদেশকে ঋণ দেবে জাপান। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় আট হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নেভিগেশন চ্যানেল টার্নিং বেসিন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলতি বছরই এর বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা।
নতুন বছরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে বনানী অংশ চালু হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। ১০ বছর আগে শুরু হওয়া প্রকল্পের অধীনে বিমানবন্দর থেকে মহাখালী, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে চিটাগাং রোড পর্যন্ত উড়ালপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। আরও পাঁচ বছর আগেই চালু হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। তবে ২০২১ সালে বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
সরকারের নেওয়া সড়কের আরেক বড় প্রকল্প সোয়া ছয় হাজার কোটি টাকার জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ হবে। এই মহাসড়কের দু’পাশে থাকছে পৃথক সার্ভিস লেন। তাই একে দেশের দ্বিতীয় এক্সপ্রেসওয়ে বলা হচ্ছে। ১৭ হাজার কোটি টাকায় নতুন বছরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দুই পাশে সার্ভিস লেন রেখে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হবে।
এ সরকারের এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, সরকারের নেওয়া সবগুলো প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে জনগণের কল্যাণে। এসব প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসব প্রকল্পের কাজ মনিটরিং করছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে খুলে দেওয়া হয়েছে। এবছরের ডিসেম্বরের মধ্যে খুলে দেওয়া হবে আরও দুটি প্রকল্প। শুধু শুধু মেগা প্রকল্পই নয়, ছোটবড় ৫৬টি প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন শেষে খুলে দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।