ডেস্ক নিউজ
দেশে যে পরিমাণ জমিতে ধান চাষ হয় (আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম) তার প্রায় ৮১ শতাংশের বেশি জমিতে উৎপাদিত হয় উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান। অন্য দিকে প্রায় ১১ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ হচ্ছে। আর দেশী বা স্থানীয় জাতের ধান চাষ হয় প্রায় ৭ শতাংশ জমিতে। ১৯৯৮ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ শুরু হলেও আবাদের পরিধি বেড়েছে বিগত পাঁচ বছরে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে যেখানে হাইব্রিড ধান চাষ হয়েছিল ছয় লাখ ৬০ হাজার ৫৬৩ হেক্টর জমিতে; সেখানে পাঁচ বছরের মাথায় ২০২০-২১ অর্থবছরে পরিধি বেড়ে ১২ লাখ ১১ হাজার ৯৯৯ হেক্টরে ঠেকেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হাইব্রিড জাতের আমন চাষ হয়েছিল ৯২ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে; সেখানে বিগত ২০২০-২১ অর্থবছর তথা পাঁচ বছরের মাথায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৪২ হাজার ৬৬১ হেক্টরে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে হাইব্রিড জাতের আউশ আবাদের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৯০৫ হেক্টর সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে আবাদ বেড়ে হয়েছে ৫৬ হাজার ৫২০ হেক্টর। উফশী বা স্থানীয় জাতের চেয়ে হাইব্রিড ধানের উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। তাই ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাইব্রিড জাতগুলো। তবে কৃষিবিদসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাইব্রিড ধানে চীনসহ কয়েকটি দেশ আমাদের জন্য উদাহরণ। চীনে প্রায় ৫০ শতাংশ জমিতেই বর্তমানে হাইব্রিড ধান চাষ হয়। বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ যেভাবে কমছে, তাতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুতই কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ধানের আবাদ ছড়িয়ে দিতে হবে। নইলে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে খাদ্যনিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ ও কো-অর্ডিনেশন) হাবিবুর রহমান চৌধুরী এক উপস্থাপনায় বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রম হ্রাসমান কৃষি জমির প্রেক্ষাপটে ধান উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান ধারা বজায় রাখার জন্য উচ্চ উৎপাদনশীল হাইব্রিড জাতের বিকল্প নেই। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক চাষের জন্য ছাড়প্রাপ্ত হাইব্রিড জাতের ৭৪ শতাংশের উৎস চীন, ১৯ শতাংশ ভারত, ৬ শতাংশ বাংলাদেশ। হাইব্রিড আবাদ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, উফশী জাতের তুলনায় হাইব্রিড ধান চাষে ৩০-৪০ শতাংশ ফলন বেশি হয়। খাদ্য অধিদফতর মোটা ধান কেনায় হাইব্রিডের চাহিদা বেড়েছে। তাই কৃষককে এতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
হাইব্রিড ধান চাষের পরিধি বাড়ছে : দেশে আউশ মৌসুমে উফশী জাত ৮৮.০৬ শতাংশ, আমন ৮১.৩৭ শতাংশ এবং বোরো মৌসুমে ৭৪.৬৪ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হয়। একইভাবে হাইব্রিড ধান চাষ হয় যথাক্রমে ৪.৩১ শতাংশ, ৪.৩৮ শতাংশ এবং ২৪.৮৭ শতাংশ জমিতে। অর্থাৎ বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষ বাড়লেও পিছিয়ে আছে আমন ও আউশে।
জানা যায়, বিগত পাঁচ বছরে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান আবাদের পরিধি অনেক বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে ৪৫ লাখ ১৭ হাজার ২৫৬ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধান চাষ হয় ছয় লাখ ৬০ হাজার ৫৬৩ হেক্টর জমিতে। পাঁচ বছরের মাথায় ২০২০-২১ অর্থবছরে হাইব্রিড ধান আবাদের পরিধি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ ১১ হাজার ৯৯৯ হেক্টরে। অর্থাৎ এই সময়ে বোরো আবাদের পরিধি প্রায় ৭.৮৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে হাইব্রিড চাষের এলাকা বেড়েছে ৮৩ শতাংশেরও বেশি। এই পাঁচ বছরে উফশী জাতের ধান প্রায় ৫ শতাংশ এবং স্থানীয় জাতের ধান চাষ ৩২ শতাংশের বেশি কমেছে।
ডিএই সূত্র জানায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৮ লাখ সাত হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ১২ লাখ তিন হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে, উফশীজাত ৩৬ লাখ ১৫ হাজার ৮০ হেক্টর ও ২০ হাজার হেক্টর। এ বছর দুই কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টন বোরো ধান উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড থেকে ৬০ লাখ ৮৭ হাজার ৯০০ টন, উফশীজাত থেকে এক কোটি ৪৮ লাখ ২৬ হাজার টন এবং স্থানীয় জাত থেকে ৩৭ হাজার টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে দুই কোটি ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টন ধান উৎপাদন করতে চায় কৃষি বিভাগ। সে ক্ষেত্রে হাইব্রিড ধান আবাদ এলাকা প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে।
বিগত পাঁচ বছরে বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি হাইব্রিড ধান চাষ হওয়া জেলাগুলো হলোÑ ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, গোপালগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, হবিগঞ্জ, বাগেরহাট, জামালপুর, রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই ১২ জেলায় যেখানে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান আবাদ হয়েছে তিন লাখ ৫২ হাজার ৬৯ হেক্টর জমিতে, পাঁচ বছর পর তথা ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ হেক্টরে। অর্থাৎ এই ১২ জেলায় হাইব্রিড ধান আবাদ এলাকা ৫১ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) ২০২০-২১ সালের মাঠ তথ্যানুযায়ী অধিক আবাদি ২৩ জেলা হলোÑ কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ। সারা দেশ মিলে যেখানে ১২ লাখ ১১ হাজার ৯৯৯ হেক্টর জমিতে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষ হয়, সেখান শুধু এই ২৩ জেলাতেই আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৭০ হেক্টর; যা এলাকা হাইব্রিড আবাদের ৭৫.৫৬ ভাগ।
৫ বছরে আমন আবাদের চিত্র : ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সারা দেশে ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮০৬ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছিল। তখন হাইব্রিড আবাদের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৪৪৭ হেক্টর। ২০২০-২১ অর্থবছর তথা পাঁচ বছরের মাথায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৪২ হাজার ৬৬১ হেক্টরে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে এক লাখ ৬২ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে আমনে হাইব্রিড ধানের চাষ বেড়েছে। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে উফশী জাতের ধান চাষ হয়েছিল ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে, সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৫ লাখ পাঁচ হাজার ৫২৭ হেক্টর। অর্থাৎ ছয় হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের আমন চাষ বেড়েছে। তবে কমেছে স্থানীয় জাতের আবাদ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে দেশে ১০ লাখ ২৩ হাজার ৯৪ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের ধান চাষ হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা প্রায় ২৩ শতাংশ কমে হয়েছে সাত লাখ ৮৮ হাজার ৬২৫ হেক্টরে বেড়েছে।
২০২০-২১ সালের ডিএইর মাঠ তথ্যানুযায়ী সারা দেশে হাইব্রিড আমন জাত আবাদ হয়েছে দুই লাখ ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, যশোর, মাগুরা, কুষ্টিয়া, নড়াইল এই ২২টি জেলাতেই আবাদ হয়েছে দুই লাখ ১২ হাজার হেক্টর; যা এই মৌসুমে হাইব্রিড আবাদের ৮৭.৬ শতাংশ।
আমন হাইব্রিড আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরামর্শ হলোÑ বিগত বছরের কম ফলনশীল জাতের আবাদ কমিয়ে হাইব্রিড ও আধুনিক জাতের আবাদ বাড়াতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
আউশ আবাদের চিত্র : গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে ১৩ লাখ ১২ হাজার ৩৮৬ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে হাইব্রিড আবাদ হয়েছে ৫৬ হাজার ৫২০ হেক্টরে, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৩৬ হাজার ৯০৫ হেক্টর। ওই বছর আউশ আবাদ ছিল ৯ লাখ ৪১ হাজার ৬৮১ হেক্টর। সেটা পাঁচ বছরে (২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত) ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে হাইব্রিড আবাদ এলাকা ৫৩ দশমিক ১৫ শতাংশ, উফশী জাত ৫৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে। তবে একই সময়ে স্থানীয় জাতের ধান আবাদ ৪০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। সরকার এই আউশ মৌসুমে হাইব্রিড ধানের চাষ বাড়াতে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
আউশ হাইব্রিড অধিক আবাদশীল জেলা : ২০২০-২১ সালের ডিএইর মাঠ তথ্য অনুযায়ী ৫৬ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের আউশ আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর-এই ১১টি জেলায় আবাদ হয়েছে ৪৯ হাজার ৪৮৬ হেক্টর; তথা মোট আবাদের ৮৭.৫৫ শতাংশই হয়েছে এই ১১ জেলায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো: বেনজীর আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে কৃষি জমি কমছে। লোকসংখ্যা প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ যোগ হচ্ছে। নতুন ফসল আসছে, যেগুলো উচ্চ মূল্যের। সুতরাং খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, হাইব্রিডে ফলন বেশি। ভালোজাত যেগুলো আছে সেগুলো বাড়াতে চাচ্ছি। তবে তিনি এ-ও বলেন, আমাদের বিজ্ঞানীরা হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছেন খুবই কম। আমদানি বেশি। সুতরাং যে বীজ দরকার সে ক্যাপাসিটি এখনো হয়ে ওঠেনি। যেহেতু হাইব্রিড ধান থেকে সংগ্রহ করা যায় না। পুরোটাই আলাদাভাবে উৎপাদন করতে হয়। তাই হাইব্রিডের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল কিছু ইনব্রিড নতুন জাত এসেছে, সেগুলো সম্প্রসারণেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।