ডেস্ক নিউজ
ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম জয়ী হয়েছেন। তাদের অভিনন্দন। সামনে তাদের কঠিন চ্যালেঞ্জ এবং সেটা উপস্থাপন করেছে ভোটাররাই। সঙ্গত একাধিক কারণ রয়েছে বটে, তারপরও ভোটারদের প্রায় চারভাগের তিনভাগ ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত- এটা উদ্বেগের কারণ বৈকি। এটাও মনে রাখতে হবে, রাজধানীর দুটি সিটি করপোরেশনে প্রায় দুই কোটি লোকের বসবাস, যাদের বড় অংশ ঢাকার কোনো সিটি করপোরেশনের ভোটার নয়। কিন্তু নাগরিক সুবিধার দাবিদার। প্রশাসনের কেন্দ্র, উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ও উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রভৃতি কারণে প্রতিদিন লাখ লাখ নারী-পুরুষ রাজধানীতে আসে। তাদের জন্যও ঢাকার মেয়র-কাউন্সিলরদের ভাবতে হয়। সরকার-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্যই নিশ্চিত করতে হয় বহুবিধ সুবিধা-সেবা।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল বিএনপি। উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে বিএনপি ৫ লাখ ৬৭৩ ভোট পেয়েছে। আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৮ লাখ ৭১ হাজার ৮০৬ ভোট। বিএনপির উত্তরের প্রার্থী ২০১৫ সালের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু পরাজয়ের পরের পাঁচ বছরে এ নির্বাচনী এলাকার জনগণ তাকে মুহূর্তের জন্যও পাশে পায়নি। নির্বাচনী প্রচার চলাকালে একাধিক বিএনপি নেতা একান্তে বলেছেন, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া গেল। শীত গেল। লবণ-পেঁয়াজের গুজব-সংকট গেল। নিত্যদিনের যানজট, জলাবদ্ধতাসহ কত ধরনের সমস্যা। কিন্তু একদিনের জন্যও তাকে দেখা গেল না নগরবাসীর পাশে। ভোটের মাঠে হঠাৎ মৌসুমী পাখির মতো উপস্থিত হলে আওয়ামী লীগের মতো তৃণমূলে বি¯তৃত দলের প্রার্থীকে মোকাবেলা করা যায় না।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে টেলিভিশনে আলোচনা চলছিল ভোটের দিন। বিএনপির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা তার ক্ষোভ গোপন রাখেননি। তিনি বলেছেন, ধানমণ্ডিতে তার বাড়িতে ভোটের প্রচারে এসেছেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ভোটকেন্দ্রে তাদের দেওয়া স্লিপ নিয়েই তিনি পোলিং বুথে প্রবেশ করেছেন। নির্বাচনের দিন অন্তত ২০টি কেন্দ্রে ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো কেন্দ্রের আশপাশেও দেখা মেলেনি বিএনপির কোনো নেতার। এত ভয় থাকলে রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি সমর্থক কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গেও কথা হয়। তাদের অভিন্ন মত- বিএনপি ‘সেলফি স্টাইলে’ প্রচার করেছে। মেয়র প্রার্থীরা টেলিভিশন ক্যামেরা হাজির না হওয়া পর্যন্ত প্রচারে বের হতে চাননি। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে বড় বড় সড়কে লিফলেট বিতরণ ও টিভিতে সাক্ষাৎ দিতে তাদের বেশি উৎসাহী দেখা গেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ব্যস্ত থেকেছে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনে। তারা জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে দক্ষিণের মেয়র পদে পরিবর্তন এনে এমন একজন প্রার্থী উপস্থিত করেছে, যার রয়েছে নিষ্কলঙ্ক ও সজ্জন ভাবমূর্তি। উত্তরের মেয়র পদে আগের প্রার্থীই বহাল। কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র ৯ মাস এবং এ সময়ের মধ্যে করিৎকর্মা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছেন।
নির্বাচনের দিন আমি নিজে অন্তত ৫০টি কেন্দ্রে ঘুরেছি। কেন্দ্রের আশপাশে কোথাও বিএনপির কোনও ক্যাম্প দেখা যায়নি। রাজধানীতে নির্বাচনের দিন প্রধান প্রধান দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে হাজির থাকে, এটা রেওয়াজ। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আচরণবিধির কারণে এটা করতে পারেননি। কিন্তু বিএনপি ১৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউই সংসদে নেই। নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন তাবিথ আওয়াল ও ইশরাক হোসেনের সঙ্গে ছবি তুলেছেন। বিএনপির দুই প্রার্থীর একজনের নামে দুদকের দুর্নীতির অভিযোগ, অন্যজন অর্থ দেশের বাইরে প্রচারের দায় বয়ে বেড়াচ্ছেন- এসব তিনি বিবেচনায় নেননি। নগরের সমস্যা নয়, দুর্নীতির কারণে সাজাপ্রাপ্ত বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিই মূল ইস্যু করেছিল বিএনপি- এটা প্রকাশ্যে বলার পরও তিনি বিচলিত হননি।
কিন্তু ভোটাররা ঠিকই বিচলিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের কাছে ‘নিবাচনে কিছু একটা করার জন্য’ যেভাবে ধর্ণা দিয়েছে, সেটা তাদের পছন্দ হয়নি। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়েও এটা করেছিল তারা। তাদের লাভ হয়নি। নির্বাচনে জয় বা পরাজয়ের নিয়ামক বাংলাদেশের ভোটাররা। বিএনপির সুবিধা হয়, এমন পাতানো নির্বাচন আয়োজনের জন্য কোনো কোনো দূতাবাসের বসদের তরফে যে চেষ্টা ছিল, তাতে লাভ হয়নি। অথচ সেই একই কৌশল দেখা গেল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়।
বিএনপি যে আদৌ বদলায়নি, সেটা স্পষ্ট হলো আরেকটি ঘটনায়- ‘ফল প্রত্যাখান করে’ রোববার রাজধানীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে তারা। ‘হরতাল চলাকালে’ আমি রাজধানীতে ঘণ্টা তিনেক ঘুরেছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে দলের কয়েকজন নেতা-কর্মী ছাড়া আর কোথাও দলের নেতা-কর্মী কারও উপস্থিতি ‘বাটি চালান দিয়েও’ খুঁজে পাইনি। সবকিছু চলেছে স্বাভাবিক ছন্দে। কেন বিএনপি হরতাল কর্মসূচি গ্রহণ করল, সেটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস তারা টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ ডেকেছিল। পেট্রল বোমার নির্বিচার ব্যবহার করেও তাতে সাড়া মেলেনি জনগণের তরফে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। তারপরও ‘ফল প্রত্যাখান করে’ হরতাল ডাকেনি। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের মোটামুটি জনসমর্থনের প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু জনবিচ্ছিনতা রয়েই গেছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা আরও প্রকট। সব ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়া যায়নি। এজেন্ট হিসেবে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে নাম গেছে, অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সস্ত্রীক কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেছে, এমন তথ্য ফেসবুকে ভাইরাল।
নির্বাচনের প্রচারাভিযানের সময়ে দলের একেক নেতা একেক কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে- সেটা প্রমাণের জন্যই বিএনপি নির্বাচন করছে। কেউ বলছেন, জনগণ আওয়ামী লীগকে উচিত শিক্ষা দেবে। কেউ বলছে, শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়বে বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষে। অন্যদিকে, মূল টার্গেট করা হয়েছে ইভিএম যন্ত্রকে। বাস্তবে কী ঘটেছে? ভোটাধিকার পাওয়া তরুণ-তরুণী থেকে বয়স্ক নাগরিক, সকলের কাছেই এ পর্যন্ত ব্যবহার করা ভোটদান পদ্ধতির মধ্যে ইভিএম-ই সেরা। এ যন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য এমনকি দলীয় পোলিং এজেন্টের দরকার নেই। আঙ্গুলের ছাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার স্ক্রিনে ভোটারের ছবি ও পরিচয় ফুটে ওঠে। বিএনপি মরণপণ চেষ্টা করেছে ইভিএমকে অকার্যকর প্রমাণ করতে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কীনা, সে বিষয়ে সন্দিহান একটি মহল। শত শত মুভি ও স্থির ক্যামেরা এবং ভোটারদের হাতে থাকা লাখ লাখ স্মার্ট ফোন নিয়ে ইভিএম-এর ফাঁকফোকড় বের করতে চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভিন্ন রায়- ভোটদানের এ পদ্ধতি সহজ ও কম ঝামেলার। ইভিএম ভাল নয়- এটা প্রমাণ করতে না পারার জ্বালা-যন্ত্রণা থেকেই কি বিএনপি হরতাল ডেকেছে? না-কি ভোটের জন্য মূল যে এজেন্ডা ঠিক করেছিল বিএনপি- বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি তাতে জনগণ সাড়া দেয়নি বলেই ক্ষোভ থেকে এ হাস্যকর কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে? হরতালে সাড়া মেলেনি। খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতেও ভোটারদের সাড়া মেলেনি। বিএনপি নেতারা জানেন, কর্মীরা এ ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। তারা হয়ত ভেবেছিলেন, হরতাল মোটামুটি সফল হলে কিছুটা মুখ রক্ষা হতেও পারে। কিন্তু এখানেও যে ব্যর্থ। বিএনপি একটু বদলায়নি। কাজেই তাদের সফল হওয়ার প্রশ্নও যে আসে না।