ডেস্ক নিউজ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বন্ধ এবং সঠিকভাবে তা প্রয়োগের কথা ভাবছে সরকার। এ জন্য আইনটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পুরো আইন বাতিল নয়, প্রয়োজনে দু-একটি ধারা সংশোধনের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, এই আইনের মামলা অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় জামিনযোগ্য করা যায় কি না, সে বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
এদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো আইন নয়, এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী যে চারটি ধারা (২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩২ নম্বর) রয়েছে, তা বাতিল করলে এবং ২৮, ৩১ ও ৩২ নম্বরসহ সব ধারা জামিনযোগ্য করা হলেই আইনটি নিয়ে আর বিতর্ক থাকবে না।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল জগতের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি আইন। এর অপব্যবহার কিভাবে বন্ধ করা যায় তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এরপর ভারসাম্য রক্ষা করে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর এই আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখতে বা পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। বিশ্বসংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত গত সোমবার জেনেভায় এক বিবৃতিতে সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানান। আইনটি বাতিলে দেশের ভেতরেও বিভিন্ন মহলের দাবি অব্যাহত রয়েছে। এই দাবিতে বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। সংবাদপত্র মালিক পরিষদ বা সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও এর আগে আইনটি বাতিলের দাবি করা হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার আইনটি পর্যালোচনার কথা ভাবছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এই আইনের অপব্যবহার যাতে না হয়, আইনটির যাতে সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার করা যায়, তা পর্যালোচনা করব। লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। একটা বিষয় স্পষ্ট যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয়নি। ডিজিটাইজেশনের এই যুগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন আছে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও কানাডার ল রিফর্ম কমিশনের সাবেক উপদেষ্টা ড. কাজী আকতার হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ নয়। পৃথিবীর কোথাও তা নেই। আমাদের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে; তবে সেটা আইনে আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে আইনের প্রয়োজন আছে। তবে আইন প্রণেতাদের খেয়াল রাখতে হবে যে এমন আইন করা যাবে না, যাতে সাধারণ মানুষ অহেতুক হয়রানির শিকার হয়। আর একটা কথা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে একজন মানুষের সম্মানহানিকর কিছু করা হলে তো সেটা দেখার অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে।’
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুরো আইনটি বাতিল করা হলে ডিজিটাল জগৎ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি এটি বাতিলের পক্ষে নই। এই আইনের বেশ কিছু ধারাঢ়াপত্তা আইনটি ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাস হওয়ার পর থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গণমাধ্যমকর্মী ৭৫ জন। এই আইনের মামলা জামিন অযোগ্য ধারায় হওয়ায় নিম্ন আদালত থেকে কোনো আসামিই জামিন পাচ্ছেন না। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলসহ এ পর্যন্ত যাঁরাই কারামুক্ত হয়েছেন, তাঁরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
আইনটির ২৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘(১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে—(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘(১) যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
আইনের ৩১ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘(১) যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সমপ্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দণ্ড হিসেবে আইনের ৩২ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘(১) যদি কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’