ডেস্ক নিউজ
দেশে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়তে শুরু করেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় বিনিয়োগের আবহ তৈরি হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৮৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বাংলাদেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই তিন মাসে ৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।
জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি, প্রায় ৫০ শতাংশ। এই তিন মাসে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪ কোটি ডলার। গত বছরের এই তিন মাসে নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, মহামারি করোনার মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ৩৩৮ কোটি ৬৮ লাখ ৬০ হাজার ডলারের (৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল বাংলাদেশে। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি ৭৩ লাখ (২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন) ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।
তার আগে ২০১৮-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।
বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অংককে নিট এফডিআই বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার ‘সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি ঋণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগে মন্দা ছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এফডিআই প্রবাহও বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে।
আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে। এ কারণেই এফডিআই প্রবাহে গতি এসেছে বলে জানান তারা।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। মূলধন হিসাবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসাবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে।
এ তিন পদ্ধতির যে কোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ এলে তা এফডিআই হিসাবে গণ্য করা হয়।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে
২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ এই পাঁচ অর্থবছরে দেশে মোট ২ হাজার ৩৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার (২০ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন) এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে নিট এফডিআই-এর পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
এই সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৭ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের সাড়ে ১৬ শতাংশের মতো বিনিয়োগ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৮ শতাংশের মতো।
এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, চীন, মিসর, যুক্তরাজ্য, হংকং এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ রয়েছে।
এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রযুক্তির অগ্রগতি, দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নত অবকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারায় সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। অন্য সূচকগুলোও ভালো। রাজনীতিতে অস্থিরতা নেই দীর্ঘদিন। সব মিলিয়ে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগেও একটি ভালো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। এখন এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিলে দেশে এফডিআই আরও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি।’
এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, ‘বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সরকার বাস্তবায়ন করছে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে। এসব প্রকল্প পিপিপির আওতায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমেও হতে পারত। সে ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত।’
এরশাদ আহমেদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগও বাড়তে হবে।
তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্টো রেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হয়ে হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগটিই এখন কাজে লাগাতে হবে।’
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে না।
তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও বেসরকারি খাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি এসেছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও নতুন উদ্যোমে বিনিয়োগ করছেন। সে কারণেই আমদানি বাড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের বিনিয়োগ জিডিপির ৩৫ শতাংশের ওপরে নিয়ে যেতে না কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া যাবে না। সে কারণে এখন যে ভালো পরিবেশ দেখা দিয়েছে, এটাকে কাজে লাগিয়ে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১ হাজার ৭৩২ কোটি ১০ লাখ (১৭ দশমিক ৩২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১ হাজার ১৭৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ৮১ কোটি ৮০ লাখ (১০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।